বাংলাদেশের লজিস্টিক ইন্ডাস্ট্রি : প্রযুক্তির প্রভাব ও বর্তমান ট্রেন্ডস

সময়ের সাথে পুরো পৃথিবীতেই বিভিন্ন খাতে পরিবর্তন ঘটছে। লজিস্টিক ইন্ডাস্ট্রিও এর ব্যতিক্রম না। প্রতিনিয়তই এই খাতের দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে নিত্য নতুন উদ্ভাবন, আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল তৈরি হচ্ছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এর প্রয়োগ করা হচ্ছে লজিস্টিক ইন্ডাস্ট্রিতে। বিশ্ব জুড়ে এই পরিবর্তনের ছোঁয়া বাংলাদেশের লজিস্টিক শিল্পেও লেগেছে। ২০২৪ সালে আমরা লজিস্টিক খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও ট্রেন্ড লক্ষ্য করেছি।
লজিস্টিক হলো পণ্য তৈরি থেকে কাস্টমারের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা, সাজানো এবং পরিচালনার পদ্ধতি। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া, একইসাথে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল শিল্প। তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য সব ধরনের পরিবর্তন এবং ট্রেন্ডসের সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। আজকের ব্লগে আমরা বাংলাদেশের লজিস্টিক ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান ট্রেন্ডস নিয়ে আলোচনা করবো। যাতে করে এই খাতে যুক্ত ব্যবসা এবং ব্যক্তিদের অগ্রগতিতে সহায়ক হয়।
এছাড়াও জেনে নিন ইলেকট্রনিক পণ্যের ছোট বা মাঝারি ব্যবসার জন্য সেরা ডেলিভারি সার্ভিস সম্পর্কে।
ডিজিটালাইজেশন এবং অটোমেশন
বর্তমান সময়ে লজিস্টিক খাতে সবচেয়ে আলোচিত ট্রেন্ড হচ্ছে ডিজিটালাইজেশন এবং অটোমেশন। এর মাধ্যমে লজিস্টিক যেকোনো অপারেশন সহজ হয়, ফলে খরচ কমে, সময় বাঁচে এবং কাজে দক্ষতা বাড়ে। লজিস্টিক অপারেশনের প্রতিটি ধাপে স্বয়ংক্রিয়তা এবং পরিবর্তন আনতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), ব্লকচেইন ইত্যাদি।
AI-ভিত্তিক সিস্টেমগুলো ব্যবহার করে পূর্বাভাসমূলক বিশ্লেষণ করা হয়। এর মাধ্যমে লজিস্টিক কোম্পানিগুলো ডেলিভারি যাতে সময়মত হয়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। রিয়েল-টাইম তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে IoT। এটি সেন্সর প্রযুক্তি এবং ক্লাউড অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে যানবাহন, সাপ্লাই থেকে ওয়্যারহাউস এবং ডেলিভারির প্রতিটি ধাপ সংযুক্ত করে। এর মাধ্যমে কাস্টমার আরও ভালোভাবে ডেলিভারি ট্র্যাকিং করতে পারে। যা আরও স্বচ্ছ এবং দক্ষ সাপ্লাই চেইন তৈরি করে। ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ের জন্যই অনলাইন ব্যবসার অন্যতম চিন্তার কারণ লেনদেন। এই দুশ্চিন্তা দূর করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি, যা দুই পক্ষের মাঝে লেনদেনের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে।
লজিস্টিক সিস্টেমকে আরও সহজ করা, যানবাহন ব্যবস্থাপনা উন্নত করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রিয়েল-টাইম ডেটা প্রদান করতে; এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) এবং ট্রান্সপোর্টেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (টিএমএস) ব্যবহার করা হচ্ছে।
রিয়েল টাইম ডেটা এনালিটিক্স
বর্তমানে লজিস্টিক ইন্ডাস্ট্রিতে রিয়েল টাইম ডেটা এনালিটিক্সের প্রয়োজনীয়তা ক্রমাগত বাড়ছে। কোম্পানিগুলো ডেটা ব্যবহার করে তাদের পণ্যবাহী যানবাহনের উপর নজর রাখে, তাদের গতিবিধি নির্ধারণ করে, স্টক পর্যবেক্ষণ করে , কোনো সমস্যা হলে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করে এবং একই সাথে কাস্টমারের কেনাকাটার অভ্যাস বিশ্লেষণ করতে পারে।
লাস্ট মাইল ডেলিভারি
একদম শেষ পর্যায়ে কাস্টমারের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হলো লাস্ট মাইল ডেলিভারি। সময়ের সাথে এটি আরও কঠিন হচ্ছে, সাথে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। সময়মত ডেলিভারি নিশ্চিত করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ডেলিভারি ট্র্যাকিং করা হচ্ছে।
কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্সে গুরুত্ব
ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ দিক কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স, যা এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। লজিস্টিক খাতে দ্রুত ডেলিভারি, কাস্টমাইজড সেবা, নিরাপদ ডেলিভারি, পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত, ট্র্যাকিং সিস্টেম ইত্যাদির মাধ্যমে কাস্টমারদের সন্তুষ্ট রাখা এখন আরও বেশি মনোযোগ পাচ্ছে। লজিস্টিক কোম্পানিদের উচিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাস্টমারদের সাথে আরও দক্ষ ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা, যাতে তাদের চাহিদা অনুযায়ী সার্ভিস দেওয়া যায়।
কাস্টমারদের ফিডব্যাক নেওয়া, সে অনুযায়ী সময়মত ব্যবস্থা নেওয়া, পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া, তাদের যেকোনো প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে উন্নত কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স নিশ্চিত করা যায়।
স্মার্ট ওয়্যারহাউস
স্মার্ট ওয়্যারহাউস অনলাইন ব্যবসা এবং লজিস্টিক খাতে অনন্য সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে অর্ডার প্রসেসিং পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়তা নিশ্চিত করতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। এসব কাজের দক্ষতা বাড়ায় এবং মানুষের ত্রুটি কমিয়ে দেয়। এতে সময় বাঁচবে, কাজ দ্রুত হবে, কর্মীদের কাজে সুবিধা হবে এবং পণ্য ও ব্যক্তির নিরাপত্তাও বাড়বে।
ই-কমার্সের আধিপত্য
বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের আধিপত্য, ২০২২ সালে ১৯% থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে মোট রিটেল সেলের ২৩%-এ বৃদ্ধি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অনলাইন শপিং বাড়তে থাকলে, লজিস্টিক সার্ভিস কোম্পানিরও দ্রুত এবং দক্ষ ডেলিভারির জন্য ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে কাজ করতে হবে। একই দিনে ডেলিভারি, কাস্টমাইজড ডেলিভারি ইত্যাদির চাহিদা বেড়ে চলছে।
সাসটেইনেবল লজিস্টিকস এবং ইকো-ফ্রেন্ডলি প্রযুক্তি
বর্তমানে যেকোনো খাতে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি এবং পণ্য ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। পরিবেশ দূষণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে সাসটেইনেবল লজিস্টিকস এবং ইকো-ফ্রেন্ডলি প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কার্বন নিঃসরণ কমানো। এই বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে লজিস্টিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইকো-ফ্রেন্ডলি বা পরিবেশবান্ধব ও বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এটি যেমন পরিবেশের জন্য ভালো, তেমনি আর্থিকভাবেও লাভজনক।
কোম্পানিগুলো একটু চেষ্টা করলেই, তাদের যানবাহনগুলো সাসটেইনেবল ও পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারে। সে সাথে যুক্ত হতে পারে আরও কিছু পদ্ধতি। যেমন, ডেলিভারির জন্য পুনরায় ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিং, রিসাইকেলিং, প্যাকেজিংয়ের জন্য পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা, বিকল্প জ্বালানি ইত্যাদি।
মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম
মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম বর্তমান সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য লজিস্টিক ট্রেন্ড। এই সিস্টেমের মাধ্যমে একাধিক পরিবহণ মাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য ডেলিভারি করা যায়। মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় মূলত সড়ক, রেল, নৌ পথ ও বিমান পরিবহণের সমন্বয়ে।
বিশেষ করে লম্বা দূরত্বে পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে এই সিস্টেম বেশি কার্যকর। এতে একদিকে কোম্পানির যেমন ট্রান্সপোর্টের খরচ কমে, অন্য দিকে কাস্টমারেরও সময় বাঁচে। ফলে, সময়ের সাথে উন্নত সার্ভিসের মাধ্যমে কোম্পানির জনপ্রিয়তা ও নির্ভরযোগ্যতা বাড়ে।
ফ্লেক্সিবল লজিস্টিক অপারেশনস
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা এখন যেকোনো ব্যবসার অন্যতম প্রধান দিক। বিশেষ করে লজিস্টিক খাতে এটি এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত ব্যবসার ট্রেন্ড বদলাচ্ছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। কাস্টমাররা অন্যান্য কোম্পানির সাথে তুলনা করে আরও দক্ষ এবং দ্রুত ডেলিভারি আর সার্ভিস চাচ্ছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে, কাস্টমাইজড সেবা, বিভিন্ন রকমের ডেলিভারি সিস্টেম, নিয়মিত ডেটা এনালিটিক্সের মাধ্যমে কাস্টমারের চাহিদা সম্পর্কে জেনে লজিস্টিক অপারেশনে ফ্লেক্সিবিলিটি আনতে হবে।
3PL এবং 4PL প্রতিষ্ঠান
থার্ড-পার্টি লজিস্টিকস (3PL) এবং ফোর্থ-পার্টি লজিস্টিকস (4PL) প্রোভাইডারদের চাহিদা বাড়ছে। কারণ কোম্পানিগুলো তাদের লজিস্টিক আউটসোর্স করে মূল ব্যবসায়িক কাজে গুরুত্ব দিতে চায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়্যারহাউস, ডিস্ট্রিবিউশন এবং পরিবহণ সার্ভিস প্রদান করে ব্যবসার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
ফিনটেক সলিউশন এবং মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মের উত্থান ছোট এবং মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলোকে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে এক করতে সাহায্য করছে এবং তাদের লজিস্টিক সার্ভিসে সহজে অ্যাক্সেসের অনুমতি দিচ্ছে। এই ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতিগুলো লজিস্টিক লেনদেনকে সহজ করছে এবং সাপ্লাই চেইনে ক্যাশ ভিত্তিক সমস্যা হ্রাস করছে।
হিমায়িত খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য এবং ওষুধের রপ্তানি বৃদ্ধির সাথে সাথে কোল্ড স্টোরেজ এবং হিমায়িত পরিবহণ সার্ভিসের চাহিদা বাড়ছে। পচনশীল পণ্যের নিরাপদ ও দক্ষ পরিবহণ নিশ্চিত করতে কোম্পানিগুলো তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রিত সাপ্লাই চেইনে বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশে লজিস্টিক খাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তরুণেরা এই পেশায় এগিয়ে আসছে, প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করছে। সে সাথে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ট্রেন্ডগুলো লজিস্টিক খাতকে আরও এগিয়ে নিচ্ছে। পরিবর্তন খুব দ্রুত হচ্ছে, তবে চিন্তার কিছু নেই। এই পরিবর্তন একইসাথে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। লজিস্টিক সেক্টরে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং প্রযুক্তি-সক্ষম লজিস্টিক অপারেশনে দক্ষ পেশাদারদের চাহিদা বাড়ছে।
লজিস্টিকসের ডিজিটাল রূপান্তরের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে, অনেক কোম্পানি প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করছে। এভাবেই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পারবে। আশা করি, আমাদের আজকের ব্লগ আপনাদের এই যাত্রা আরও সহজ করবে।