ফেসবুকে ব্যবসা শুরুর আগে উদ্যোক্তাদের যা জানা জরুরি

তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক হয়ে উঠেছে ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বিশাল সুযোগ। যোগাযোগ রক্ষা থেকে শুরু করে বিজনেসের প্রচার সবই করা হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। বিশেষ করে, যারা স্বল্প উদ্যোগে ঘরে থেকেই আয় করতে চায়, তাদের জন্য ফেসবুক জনপ্রিয় মাধ্যম। কিন্তু, যেকোনো ব্যবসাতেই শুরুটা কঠিন থাকে। আর সেটা যদি হয় অনলাইনে অথবা ফেসবুকে, তার সাথে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়। অনেক উদ্যোক্তাই এই বিষয়গুলো না জানার কারণে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে।
আজকের আর্টিকেলে ফেসবুকে নতুন ব্যবসা শুরুর আগে উদ্যোক্তাদের যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করবো।
বিজনেস প্ল্যান
যেকোনো কিছু শুরুর আগে একটি বিস্তারিত প্ল্যান দরকার। আপনার প্রোডাক্টের ডিটেইলস, দাম, কোথা থেকে নিবেন, কোথায় রাখবেন, ডেলিভারি সিস্টেম এসব লিখুন। সাথে আপনার ব্র্যান্ডের নাম, বর্ণনা, আপনার স্ট্র্যাটেজি, টার্গেট অডিয়েন্স, বিজনেস কম্পিটিটর, আপনার লক্ষ্য, সময় সবকিছু যুক্ত করুন।
ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
ব্যবসার শুরুতে ট্রেড লাইসেন্স থাকতে হবে। এটি আপনার ব্যবসাকে নিরাপত্তা দিবে, কাস্টমারের মাঝে বিশ্বস্ততা তৈরি করবে এবং আপনার মাঝে পেশাদারি মনোভাব তৈরি করবে। এতে আইনগত বৈধতা তৈরি হয়। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভায় অল্প ফি দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স করা যায়। বাংলাদেশে ই-কমার্স হিসাবে আলাদা খাত নেই, তাই আইটি খাতে ট্রেড লাইসেন্স করা যায়। একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও থাকা উচিত। আপনার ব্যবসার সব লেনদেন একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে থাকবে। প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে সহজ হবে।
টার্গেট অডিয়েন্স
প্রথমেই আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনার পণ্য বা সেবার টার্গেট অডিয়েন্স কারা। তাদের চাহিদা কী কী, তাদের জন্য কেমন কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে। শুরুতেই আপনাকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করতে হবে। আপনার মনে রাখতে হবে, আপনার ব্যবসা শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যমই নয়, বরং মানুষের সমস্যা সমাধানের উপায়। নয়ত, কেউই আপনার পণ্য বা সেবা ক্রয় করবে না।
বিজনেস কম্পিটিটর
ভালো ব্যবসায়িক স্ট্রাটেজির অন্যতম দিক হলো বিজনেস কম্পিটিটর সম্পর্কে জানতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে কেন কাস্টমার আপনাকে বেছে নিবে। তাদের সোশ্যাল মিডিয়া রিসার্চ করে স্ট্রাটেজি, ব্যবহৃত কিওয়ার্ড, কীভাবে প্রচার করছে তা বুঝতে হবে।
অথেনটিক প্রোডাক্ট
ব্যবসা বড় হোক বা ছোট, আপনাকে ভালো মানের আসল প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করতে হবে। কোথা থেকে এবং কীভাবে প্রোডাক্ট নিবেন তা ঠিক করে নিন। চেষ্টা করবেন যাতে এটি সহজ এবং খরচ কম হয়। ২/৩টি ব্যাকআপও রাখুন প্রোডাক্টের, যাতে কাস্টমার সবসময় প্রোডাক্ট হাতে পায়। তবে, অবশ্যই পণ্যের মান ঠিক রাখতে হবে। আপনার প্রোডাক্ট থেকে শুরু করে, প্যাকিজিং, ডেলিভারি, কাস্টমার সার্ভিস সবকিছু গোছানো হতে হবে। তাছাড়া আপনি যা যা তথ্য দিচ্ছেন, তা যেন সঠিক হয় সেটি নিশ্চিত করুন। প্রতিটি পদক্ষেপে আপনাকে সৎ থাকতে হবে। পণ্য নিজে তৈরি করলে, কতটুক সময়ে কী পরিমাণ কাজ করতে পারবেন, তার উপর নির্ভর করে অর্ডার নিন।
ডেলিভারি সিস্টেম
অনলাইন ব্যবসার অন্যতম কঠিন বিষয় প্রোডাক্ট ডেলিভারি । অনেক সময় দেখা যায় ডেলিভারি দিতে দেরি হচ্ছে, প্রোডাক্ট নষ্ট হচ্ছে বা ভেঙে যাচ্ছে, কাস্টমারের সাথে যোগাযোগ ঠিকমতো না করা, কাস্টমারের সাথে খারাপ ব্যবহার করা ইত্যাদি আপনার সুনাম নষ্ট করে দিতে পারে। তাই ভালো কুরিয়ার সার্ভিস বেছে নিন।
ডেলিভারি দেয়ার জন্য ট্রাক ভাড়া করার সময় যেসকল বিষয় মনে রাখবেন
ফেসবুক পেজ
ফেসবুকে আপনার ব্যবসা চালানোর জন্য ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম আপনার ফেসবুক পেজ। এটি আপনার ব্যবসার পরিচয় এবং ক্রেতার সাথে সংযোগের মাধ্যম। পেজে একটি সুন্দর এবং উপযুক্ত প্রোফাইল পিকচার, কভার ফটো এবং সাথে আপনার পণ্য অথবা সেবার সুস্পষ্ট বিবরণ থাকতে হবে। খেয়াল রাখবেন, এই তথ্যগুলো যেন আপনার ব্র্যান্ডকে প্রতিফলিত করে।
নিয়মিত কনটেন্ট
পেজ সক্রিয় রাখতে নিয়মিত কনটেন্ট পোস্ট করা জরুরি। আপনার পণ্য বা সেবার বিস্তারিত বর্ণনা, অর্ডার করার পদ্ধতি, পেমেন্ট প্রক্রিয়া, নতুন শিপমেন্ট ইত্যাদি কনটেন্টের মাধ্যমে নিয়মিত জানাতে হবে। একইসাথে রিভিউ পোস্ট, আপনার বিজনেসের সাথে প্রাসঙ্গিক এবং সম্পর্কিত কনটেন্ট তৈরি করুন। কনটেন্ট ভিডিও, ছবি এবং লেখাসহ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তাছাড়া, বিভিন্ন উৎসবে ছাড়ের অফারও থাকতে পারে।
ইন্টারেকশন বাড়ানো
ফেসবুকে বিজনেসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আপনার পেজ এবং গ্রুপে, ফলোয়ারদের সাথে ইন্টারেক্ট করা। তাদের কমেন্ট এবং মেসেজের উত্তর দেওয়া, সাথে লাইভ এবং প্রশ্ন-উত্তর সেশনও থাকতে পারে। বিভিন্ন ইভেন্ট, অফার এবং পোল ব্যবহার করতে পারেন।
পেইড অ্যাডভার্টাইজিং
পেজের রিচ বাড়াতে অর্গানিক অ্যাডভার্টাইজিংয়ের সাথে পেইড অ্যাডভার্টাইজিং ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবসার শুরুতেই এর প্রয়োজন নেই। প্রথমে পেজের পরিচিতি বাড়ুক, রেগুলার কাস্টমার আসুক। তারপর পেইড অ্যাডভার্টাইজিং করতে পারেন। ফেসবুক অ্যাড ম্যানেজার ব্যবহার করে আপনার টার্গেট অডিয়েন্সের জন্য, বিভিন্ন ধরনের অ্যাড ফরম্যাট ব্যবহার করে কার্যকর ক্যাম্পেইন করতে পারেন। চাইলে ইনফ্লুয়েন্সারদের সাথে কাজ করে আপনার পণ্য বা সেবার প্রচার করতে পারেন। অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলের সাথে ফেসবুক পেজকে ক্রস-প্রমোট করেও এই কাজ করা যায়।
অ্যানালিটিক্স ব্যবহার
পেজের পারফরম্যান্স ট্র্যাক করতে অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করুন। কোন কনটেন্ট ভালো করছে, কোন কনটেন্টের পরিবর্তন দরকার, কোন সময়ে কখন কনটেন্ট দিলে ভালো হবে তা বুঝতে পারবেন অ্যানালিটিক্স থেকে। সাথে ফেসবুক পিক্সেল ইন্সটল করে ওয়েবসাইটে ভিজিটরদের ট্র্যাক করে তাদের অ্যাক্টিভিটি সম্পর্কে জানতে পারবেন।
কাস্টমার রেকর্ড
আপনার ব্যবসার নিরাপত্তার স্বার্থে কাস্টমার রেকর্ড রাখা জরুরি। অনলাইনে পাওয়া যেকোনো কাস্টমারের তথ্য গুগল স্পেডশিট বা এক্সেলে সংরক্ষণ করা উচিত। সাথে ব্যাকআপ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। পরবর্তী বিভিন্ন মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে অফার বা নতুন প্রোডাক্টের প্রচার চালাতে সহজ হবে। সাথে প্রোডাক্ট লিস্ট, দাম, মেয়াদ বা প্রফিট ইত্যাদি ডাটাও রাখতে হবে। খেয়াল রাখবেন, আপনার আইটি সিস্টেম যাতে অবশ্যই আপডেট থাকে এবং এর নিয়ন্ত্রণ ও অ্যাক্সেস নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বস্ত ব্যক্তির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে।
ব্র্যান্ড প্রোমোশন
ফেসবুকে ব্যবসার উন্নতি করতে ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি প্রয়োজন। যা আপনার কাজের নিজস্বতা তুলে ধরবে, আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করবে। আপনার পেজের লোগো, কালার প্যালেট এবং ভয়েস টোন সবকিছু আপনার ব্র্যান্ডকে তুলে ধরবে। সে সাথে ভালো কাস্টমার সার্ভিস, কোয়ালিটি প্রোডাক্ট এবং সঠিকভাবে ডেলিভারি দেওয়া ইত্যাদি কাজ সঠিকভাবে করতে হবে।
প্রোডাক্টের রিটার্ন পলিসি, ওয়ারেন্টি ইত্যাদি একটি নিয়মের মাঝে রাখুন। কাস্টমারকে রিভিউ দিতে উৎসাহিত করুন। গুগল অ্যালার্ট সেট করে আপনার ব্র্যান্ডের যেকোনো খবর জানতে পারবেন। কাস্টমারের যেকোনো অভিযোগ সামলানো শিখুন। এমনকি কাস্টমারের দোষ থাকলেও, কীভাবে তা সমাধান করবেন ঠিক করে রাখুন। সেজন্য একটি দক্ষ টিম প্রয়োজন। আপনার কাস্টমার সাপোর্টের কাজ তারা করবে। তাদের অবশ্যই আপনার ব্র্যান্ড ও প্রোডাক্ট সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। তাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থাও করতে হবে।
ট্রেন্ড ফলো করা
ফেসবুকের অ্যালগোরিদম এবং ফিচার নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। আজকাল প্রতিনিয়ত নতুন ট্রেন্ড আসে। কাস্টমারের সাথে সংযুক্ত থাকতে এবং ব্যবসাকে সফল রাখতে এই ট্রেন্ডগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করুন।
ওয়েবসাইট
আপনি যদিও ফেসবুকে ব্যবসা করছেন, তারপরও ব্র্যান্ডের গুরুত্ব এবং প্রচার বাড়াতে ওয়েবসাইট কার্যকর। ওয়েবসাইটে প্রোডাক্ট ডেসক্রিপশন, ছবি, ভিডিও পাবলিশ করুন। আপনার বিজনেস এবং প্রোডাক্ট সম্পর্কিত ব্লগ পাবলিশ করুন। এতে কাস্টমারের অনেক সমস্যার সমাধান থাকতে পারে। আপনার নতুন কাস্টমারও ব্লগের মাধ্যমে যুক্ত হবে। ফেসবুকে ওয়েবসাইটেরও পাবলিসিটি করুন। যা ভবিষ্যতে আপনার ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসাকে বড় পর্যায়ে নিতে সাহায্য করবে।
ফেসবুক একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম যেখানে আপনি যেমন উদ্যোক্তা হিসাবে নতুন বিজনেস শুরু করতে পারেন। তেমনি ব্যবসার প্রসার বাড়াতে পারেন। তবে, সফল হওয়ার জন্য আপনাকে একটি সঠিক পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তাই আপনাকে ধৈর্য রাখতে হবে। ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসা রাতারাতি সফল হয় না। সফল হতে সময় এবং ধৈর্য লাগে। আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যান। সময় এবং ফলাফল অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে থাকুন। আশা করি, উপরের টিপসগুলো অনুসরণ করে আপনি আপনার ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসাকে সফল করতে পারবেন।