নতুন বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় সতর্কতা ও করণীয়
নতুন বাসায় যাওয়া সবসময়ই অনেক আনন্দের। এটি একটু অ্যাডভেঞ্চারও বটে। তবে, সাথে একটু ভয় আর চিন্তারও। তবে নতুন সবকিছুই এই বিপরীতধর্মী অনুভূতি দেয়। কিন্তু তারপরও সবারই এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কারো কারো জন্য এটা একদম প্রথম অভিজ্ঞতা। অনেক জায়গা ঘুরে নিজের বাজেট আর পছন্দ মতো বাসা খুঁজে পাওয়া সহজ কথা নয়। তার সাথে সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে অনেকেই ভুল করে ফেলেন।
আজকের আর্টিকেলে আমরা কিছু টিপস এবং পরামর্শ শেয়ার করতে চেষ্টা করবো, যা আপনার পছন্দের বাসা খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। এই বিষয়গুলো বাসা নেওয়ার আগে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে আপনার এই যাত্রা নিরাপদ হয়। নতুন বাসা নেওয়ার আগে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন থাকে, ফলে তারা বিভিন্ন ভুল করে ফেলে। আজকের এই আলোচনা তাদের জন্য।
বাজেট
সবার প্রথমে আপনার বাজেটের দিকে তাকাতে হবে। নতুন বাসা ভাড়া, সিকিউরিটি ডিপোজিট, বাসা শিফটের খরচ, নতুন কিছু কেনার খরচ, নতুন বাসার বিলের খরচ ইত্যাদি আপনার বর্তমান বাসার সাথে তুলনা করে নিন।
বাসার অবস্থান
বাসা নেওয়ার আগে এর আশেপাশের পরিবেশ দেখে নিন। আবাসিক এরিয়া বাছাই করা উচিত। বাণিজ্যিক বা শিল্প প্রতিষ্ঠান কিংবা ফ্যাক্টরির কাছে বাসা না নেওয়াই ভালো। আপনার বাড়ির সাথে অন্য বাড়ি একদম কাছে থাকলে সামান্য দুর্ঘটনায় বিশাল ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়াও নতুন বাসা আপনার অফিস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে কি না তা ভালোভাবে দেখে নিন।
বাসার ইন্টেরিয়র
প্রথমেই বাসার ভেতরে এবং বাইরে ভালোভাবে দেখে নিন। বিশেষ করে বাড়ির দেয়াল, এখানে ছত্রাকের আক্রমণ হয়েছে কি না তা দেখতে হবে। নয়তো স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হবে। কতটি বৈদ্যুতিক আউটলেট রয়েছে, প্রয়োজনীয় স্থানে আছে না কি, বিদ্যুৎ সংযোগ ঠিক আছে না কি তাও চেক করতে হবে।
ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস আসার ব্যবস্থা আছে না কি চেক করুন। জানালার অবস্থান, জানালার সামনে অন্য বিল্ডিং আছে না কি, সুরক্ষা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। বাড়িতে পর্যাপ্ত আলো না থাকলে সারাদিন লাইট জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ বিল বেশি আসবে। তাছাড়া, সুস্থ থাকার জন্যও এর প্রয়োজনীয়তা আছে।
পার্কিং
আপনার যদি গাড়ি, মোটরসাইকেল থাকে তবে পার্কিংয়ের জায়গা দেখে নেওয়া আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ঐ স্থানের আকার, নিরাপত্তা , কোনো বিশেষ নিয়ম থাকলে সবকিছু বিস্তারিত জেনে নিন।
নিরাপত্তা
নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখার জন্য বাড়ির আশেপাশে খোঁজ নিন। অনলাইনে বাসা খুঁজে পেলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে স্ক্যাম না হয়। এলাকা, এলাকাবাসী, কাছাকাছি হাসপাতাল ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে। এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নাইট গার্ড, সিসি ক্যামেরা আছে না কি চেক করুন। আপনার প্রতিবেশী সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করুন। তাদের সাথেই তো আপনার লম্বা সময় কাটাতে হবে, তাই তাদের সম্পর্কে জেনে নেয়া ভালো। বিপদে-আপদে সাহায্য পেতে কাজে লাগবে।
একই সাথে বাড়িওয়ালা সম্পর্কেও জানুন। বাড়িওয়ালার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আগের ভাড়াটিয়ার চলে যাওয়ার কারণ, বাড়িটি বিক্রির জন্য চেষ্টা চলছে কি না, বাড়ির মালিকানা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা আছে কি না জেনে নিন।
তথ্য ফরম
বর্তমানে প্রতিটি বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার তথ্য নির্ধারিত ফরমে পূরণ করে সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে হয়। বাড়ি ভাড়া নেয়ার পর পরই এই কাজটি করে ফেলুন।
চাবি
বাড়ির চাবি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস। এর দিকে বাড়তি মনোযোগ দিন। অনেক দুর্ঘটনা শুধু এই চাবি দিয়েই শুরু হয়েছে। বাড়ির মেইন গেট, আপনার অ্যাপার্টমেন্টের মেইন গেট এবং অন্যান্য রুমের চাবি নিরাপদ জায়গায় জোড়ায় জোড়ায় রাখুন।
পানি ও গ্যাস
বর্তমানে ঢাকা শহরে পানি ও গ্যাসের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিছু কিছু এলাকায় এই সমস্যা প্রবল। ভাড়ার সাথে পানি ও গ্যাসের বিল, পানি ও গ্যাসের সরবরাহ নিয়মিত কি না, পানি পরিষ্কার কি না ইত্যাদি জেনে নিতে হবে।
পোষা প্রাণী
আপনার পোষা প্রাণী থাকলে তা রাখার অনুমতি আছে কি না জেনে নিন। অনেক হাউজিং সোসাইটিতে পোষা প্রাণী রাখার অনুমতি থাকে না। থাকলেও বিশেষ নিয়ম থাকতে পারে। সে সাথে আপনার পোষা প্রাণীর জন্য পার্ক, হাসপাতাল বাড়ির কাছে আছে না কি চেক করে নিন।
চুক্তি
বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাসা ভাড়ার দলিল। আগে এই চুক্তি হতো মৌখিক। ফলে পরবর্তীতে অনেক বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হতো। তাই এখন লিখিত চুক্তি হয়। আর চুক্তিতে সবকিছু বিস্তারিত লেখা থাকে যাতে কোনো সমস্যা না হয়।
উদ্দেশ্য
বাসাটি আবাসিক না কি ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত হবে তা চুক্তিতে থাকতে হবে। অনেক সময় চুক্তি ভঙ্গ করে অন্য কাজে বাসা ব্যবহৃত হয়। এর সাথে নিরাপত্তার বিষয় এবং ঐ বাড়িতে থাকা অন্য বাসিন্দাদের মতামত জড়িয়ে আছে।
সময়
কত সময়ের জন্য বাসাটি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে তা পরিষ্কারভাবে চুক্তিতে উল্লেখ করতে হবে। বাসা ছেড়ে দিলে কতদিন আগে জানাতে হবে, তাও উল্লেখ করা উচিত।
ভাড়া ও পরিশোধ পদ্ধতি
ভাড়া কত হবে এবং তা কীভাবে পরিশোধ হবে তা খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। ক্যাশ, ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিং কোন পদ্ধতি ব্যবহার হবে, প্রতি মাসে না কি ৩-৬ মাসের ভাড়া একবারে দিতে হবে এসব চুক্তিতে থাকতে হবে। ভাড়া বাড়ানো হবে কি না, বাড়ানো হলে কখন এবং কী পরিমাণ তাও উল্লেখ করতে হবে।
প্রতি মাসে ভাড়ার একটি রিসিট রাখুন। সাথে পানি ও বিদ্যুতের হিসাব রাখুন। কোনো বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে কি না, মিটার আলাদা কি না এসব তথ্য আগে থেকে জেনে নিন।
সিকিউরিটি ডিপোজিট
ভাড়ার সময়ের অগ্রিম টাকা হলো সিকিউরিটি ডিপোজিট । এটি বাড়িওয়ালার কাছে জমা থাকে, বাসা ছাড়ার সময় ফেরত দিয়ে দেয়। আবার বাসার কোনো ক্ষতি হলে, সে পরিমাণ অর্থ কেটে রাখা হয়। এটি নির্ভর করে বাড়ির উপর। সাধারণত ২-৩ মাসের টাকা অগ্রিম দিতে হয়। আবার অফিসের ক্ষেত্রে ৬ মাসের ভাড়া অগ্রিম দিতে হতে পারে।
বাড়িওয়ালার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করুন। অন্য কারো মাধ্যমে বাসা ভাড়া নিলে অনেক সময়ই ভাড়ার পরিমাণ, নিয়ম, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে পরে সমস্যা তৈরি হয়। বাসায় আসার আগেই কোনো কিছু নষ্ট থাকলে যেমন পানির কল, দেয়ালের রং ইত্যাদি বাড়িওয়ালাকে বলে ঠিক করিয়ে নিন। তাছাড়া বাড়ির কোনো বিশেষ নিয়ম, মেইন গেট, লিফট, গ্যারেজ ইত্যাদি ব্যবহারের নিয়ম, সময় ইত্যাদিও চুক্তিতে উল্লেখ করা যেতে পারে। চুক্তির দুটি কপি রাখুন।
চুক্তিটি কয়েকবার পড়ুন
বাসা ভাড়ার চুক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ আর জটিল একটি ডকুমেন্ট। এর সাথে আপনার নিরাপত্তা আর আইনি সম্পর্ক আছে। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হলে এটি আপনাকে সাহায্য করবে। তাই এটি বারবার পড়ুন। ভালোভাবে প্রতিটি পয়েন্ট চেক করুন। কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে কোনো উকিলের শরণাপন্ন হন। বাড়িওয়ালা কোনো বাড়তি শর্ত যোগ করেছেন কি না দেখুন। আপনার নিজের কোনো কিছু যুক্ত করতে চাইলে জানান। আপনার একটু সতর্কতা আপনাকে সামনের যেকোনো বিপদ থেকে বাঁচাবে।
একটি নতুন বাসা বা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়া একইসাথে আনন্দের এবং চিন্তার বিষয়। তবে যখন পুরো জিনিসটা আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণে, তখন কিছুটা হলেও আপনার চিন্তা দূর হবে। অবশ্যই কিছু বাধা আসবে, কিন্তু সময় নিয়ে চেষ্টা করলেই তা অতিক্রম করতে পারবেন। আশা করি, আমাদের এই টিপস এবং উপদেশ আপনাকে আপনার পছন্দের বাসা সহজে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।