বাসা পরিবর্তনের সহজ উপায়
মাসের শুরতেই বাসা পরিবর্তন! দৈনন্দিন শত কর্মব্যস্ততার মধ্যে এ যেন আরেক ঝামেলা। শহরের চাকুরীজীবি মানুষের জন্য বাসা পরিবর্তনের আরেক নাম বিড়ম্বনা। নতুন বাসা খুঁজে পাওয়া থেকে শুরু করে বাসায় জিনিসপত্র শিফট করা এ যেন ধাপে ধাপে ভোগান্তি।
যিনি এ ঝামেলায় একবার পড়েছেন; জীবনে আর কখনো এই বাসা পরিবর্তনের ঝামেলা মাথায় নিতে চায় না। কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে ছোট ছোট জিনিসপত্র -সব গুছিয়ে করতে হয় বাসা পরিবর্তন। চলুন জেনে নেই আপনার বাসা পরিবর্তন করার ঝামেলা কমিয়ে আনার কিছু কার্যকরী উপায়।
বাসা পরিবর্তনের সহজ উপায়
১.পরিকল্পনা ও পূর্বপ্রস্তুতি
সবকিছু একদম শেষ মুহুর্তের জন্য ফেলে রাখা আমাদের চিরাচরিত অভ্যাস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ বদঅভ্যেস আমাদের নানা বিড়ম্বনায় ফেলে। আপনিও যদি আমাদের মধ্যে একজন হয়ে থাকেন; তবে অবশ্যই বলবো বাসা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসুন। কেননা এই সুষ্ঠু ভাবে পরিকল্পনা ছাড়া অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বাসা পরিবর্তনের ৩০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যেই মাথায় সেট করে ফেলুন- আপনাকে কখন,কী কী কাজ করতে হবে এবং এই কাজ গুলো সম্পন্ন করতে আপনি কি একা পারবেন নাকি কাউকে প্রয়োজন হবে। যদি প্রয়োজন হয় বন্ধুবান্ধব বা কয়েকজন লোককে বলে রাখলেন।
২.গুরুত্বপূর্ণ কাজের লিস্ট করা
বাসা পরিবর্তনের মতো একটি বড় কাজে কোনো কিছু মিস হয়ে যেতে পারে। কারণ এত কাজের ভীড়ে দেখবেন কিছু না কিছু মাথায় রাখতে পারেন নি। এই ঝামেলা এড়াতে আমরা বলবো আগেই লিস্ট আউট করেন আপনার সামনের কাজগুলো কি কি।যেমন ধরুন- বর্তমান বাড়িওয়ালাকে জানানো, নতুন বাসা কনফার্ম করেছেন কিনা, নতুন বাসায় কি কি জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন তার তালিকা করা, প্যাকেজিং এর জিনিসপত্র, মালবাহী ট্রাক বা ভ্যান বুকিং ইত্যাদি আরো কতো কি! তাই সবকিছু আগেই ঠান্ডা মাথায় লিস্ট করে রাখুন।
৩.সঠিক পরিবহন সিলেক্ট করুন
আপনার বাসার মালামাল কীসের মাধ্যমে শিফট করবেন তা ঠিক করে রাখা অতীব জরুরি। যদি স্বল্প দুরত্বের স্থানে শিফট করেন; হয়তো ছোট ট্রান্সপোর্টেই কয়েক ট্রিপে মালামাল নিয়ে আসতে পারবেন।কিন্তু বারবার ট্রিপে আনা-নেওয়ায় আপনার খরচ দ্বিগুন পরতে পারে। তাই আপনার মালামালের পরিমাণ এবং সাইজের উপর ভিত্তি করে ট্রাক বা পিকআপ ভ্যান ঠিক করে ফেলুন।
- সাধারণভাবে, ব্যাচেলর বা একজনের জন্য বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর মাল নেওয়ার জন্য ১৬ কিউবের ট্রাকের প্রয়োজন হবে।
- অন্যদিকে, দুই থেকে তিনরুমের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর মাল নেওয়ার জন্য ২৫-২৬ কিউবের ট্রাকের প্রয়োজন হবে।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাসার মালামাল ২৪ কিউবের ট্রাক করে ২-৩বার ট্রিপে সহজেই শিফট করা যায়।
৪.প্যাকেজিং এর সরঞ্জাম সংগ্রহ করুন
প্যাকিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে রাখা সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ।বাসার প্রয়োজনীয় মালামাল শিফট করতে কি কি সরঞ্জাম লাগবে তা আগেই কিনে রাখুন। যাতে বাসা পরিবর্তনের দিন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে না হয়। এগুলো আগাম সংগ্রহ করে রাখলে আপনার কাজগুলো সুন্দর অর্গানাইজেড ভাবে হবে। যেমন ধরুন-
বিভিন্ন সাইজের কার্টন বাক্স সংগ্রহ করুন। ছোট বাক্সে ছোট জিনিসপত্র এবং বড় বাক্সে বড় জিনিসপত্র প্যাক করতে সুবিধা হয়।
- পেপার রোল এবং প্যাকিং টেপ: ভঙ্গুর জিনিসপত্র যেমন কাচের জিনিস, পাত্র ইত্যাদি প্যাক করার জন্য পেপার রোল ব্যবহার করুন এবং বাক্সগুলো সঠিকভাবে বন্ধ করার জন্য প্যাকিং টেপ ব্যবহার করুন।
- বাবল র্যাপ: ভঙ্গুর ও মূল্যবান জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখার জন্য বাবল র্যাপ ব্যবহার করতে পারেন।
- মার্কার পেন: বাক্সের উপর যেকোনো জিনিসের নাম ও গন্তব্য লিখতে মার্কার পেন ব্যবহার করুন, যাতে নতুন বাসায় সহজে খুঁজে পাওয়া যায়।
- স্টিকার ও লেবেল: বাক্সগুলোর জন্য স্টিকার বা লেবেল ব্যবহার করে ভেতরে কি আছে তা লিখে রাখুন। এটি অর্গানাইজ করতে সাহায্য করবে।
- প্যাকেজিং কোম্পানি: অনেক মুভিং কোম্পানি প্যাকেজিং সামগ্রী সরবরাহ করে। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে প্রয়োজনীয় সামগ্রী আগে থেকেই পেয়ে যাবেন।
এই প্রস্তুতির মাধ্যমে প্যাকিং অনেকটাই সহজ হবে এবং বাসা পরিবর্তন আরো মসৃণভাবে সম্পন্ন হবে।
৫.নতুন বাসার সিড়ি ও দরজার পরিমাপ নিন
নতুন বাসার দরজা এবং সিঁড়ির সঠিক পরিমাপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি নিশ্চিত করে যে আপনার বড় মালামালগুলো সহজে প্রবেশ করতে পারবে। দরজার উচ্চতা ও প্রস্থ পরিমাপ করুন। বিশেষ করে বড় ফার্নিচার বা যন্ত্রপাতি (যেমন সোফা, খাট) আনতে হলে, দরজার প্রস্থ যথেষ্ট বড় হতে হবে। সিঁড়ির প্রশস্ততা এবং উচ্চতা পরিমাপ করুন। সিঁড়ির কোন অংশে বাঁক আছে কিনা তাও পরিমাপ করুন। কিছু বড় আসবাবপত্র সিঁড়ি দিয়ে ওঠাতে বা নামাতে সমস্যা হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কোন ধরনের আসবাবপত্র বা যন্ত্রপাতি যদি খুব বড় হয়, তাহলে সেগুলো নতুন বাসায় প্রবেশ করানোর আগে কোনভাবে সেটি মডিফাই করা যাবে কিনা তাও পরিকল্পনা করুন।
পরিমাপ নিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা করলে মালামাল পরিবহন অনেক সহজ হবে এবং নতুন বাসায় শিফট করার সময় যেকোনো অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
৬.অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিন
আসুন মেনে নেই, মানুষ জিনিসপত্র তার সংগ্রহে রাখতে ভালোবাসে। কেননা এর সাথে নানা স্মৃতি ও মায়া জড়িত থাকে। কিন্তু এই অব্যবহৃত মালামাল গুলো বহন করা যেমন কষ্টকর, তেমনি নতুন বাসায় এই জিনিস দিয়ে বিশৃঙ্খলা হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। এই অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিতে ৯০/৯০ ফর্মূলা ব্যবহার করুন। কীভাবে? দেখুন গত ৯০ দিনের মধ্যে কোন জিনিসগুলো একবারেই আপনার কাজে আসে নি এবং আগামী ৯০ দিনের মধ্যে কোনগুলো একবারেই কাজে আসবে না। এই দুটি প্রশ্নের উত্তরই আপনাকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কোনগুলো শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।
৭.প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী জিনিস প্যাক করুন
নতুন বাসায় চলে যাওয়ার সময় কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আগে থেকেই প্যাক করা উচিত, যাতে নতুন বাসায় পৌঁছে দ্রুত প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলি কাছে পাওয়া যায়। যেমন - রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় পাত্র, কুকিং যন্ত্রপাতি, এবং মৌলিক মশলা এগুলো আগে থেকেই প্যাক করে রাখুন। বিছানার চাদর, তোষক, বালিশ এবং কম্বল প্যাক করে রাখুন। নতুন বাসায় পৌঁছেই তাহলে সবার বেডরুম রেস্ট নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে। টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু, তোয়ালে, এবং অন্যান্য কিচেন টুলস, ক্লিনিং প্রোডাক্টস একসাথে প্যাক করে রাখুন।
৮.মালামাল অনুযায়ী আলাদা প্যাক করুন
মালামাল অনুযায়ী আলাদা প্যাকিং করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ভঙ্গুর এবং বিশেষ ধরনের জিনিসপত্রের জন্য। কাচের জিনিসপত্র (যেমন ডিনার সেট, কাচের গ্লাস) এসব আলাদা করে প্যাক করুন। যদি সম্ভব হয় কাগজ বা কাপড়ে মুড়িয়ে দিন; এতে করে ঝাকুনিতে ভাঙার সম্ভাবনা কমে। ক্রোকারিজ (যেমন চামচ, কাঁটা চামচ, থালা): এগুলোকেও আলাদা বাক্সে প্যাক করুন। এবং নিশ্চিত করুন যে প্রতিটি আইটেম সঠিকভাবে সুরক্ষিত আছে ।বাচ্চাদের খেলনা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসও আলাদা করে প্যাক করুন। শিশুদের জিনিসগুলি সহজে পাওয়ার জন্য একটি বিশেষ বাক্সে রাখুন।সব মালামাল প্যাকিং করার পর একটি চেকলিস্ট তৈরি করুন এবং প্রতিটি বাক্সে লেবেল লাগান। যেমন—"ভঙ্গুর কাচের জিনিস", "বাচ্চাদের খেলনা", ইত্যাদি।
৯.প্রয়োজনীয় সার্ভিসগুলোর চেকলিস্ট তৈরি করুন
আপনি নতুন বাসায় উঠলেন দেখলেন ওয়াইফাই নেই; এর থেকে খারাপ কি হতে পারে। বাসা পরিবর্তনের সময় কিছু নির্দিষ্ট সার্ভিসের প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষ করে যদি আপনি নিজে নিজে মুভিং করেন বা মুভিং সার্ভিস প্রোভাইডার সব ধরনের সার্ভিস না দেয়। এর মধ্যে রয়েছে এসি, গিজার, প্লাম্বিং, গ্যাস ,ওয়াইফাই ইত্যাদি। তাই আপনার নতুন বাসায় কি কি সার্ভিসের প্রয়োজন হবে তা মুভ ইন ডেটের আগেই চেক করে নেওয়া যাতে বাসায় শিফটের পর কোনো ভোগান্তি না হয়।
১০.বিভিন্ন মুভিং সার্ভিসের সাহায্য নিন
আপনার যদি সময়ের স্বল্পতা থাকে, তবে আপনি সহজেই পেশাদার মুভিং সার্ভিসের সাহায্য নিয়ে বাসা পরিবর্তন করতে পারেন। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস অফার করে থাকে। তাদের সঠিক প্যাকিং এবং পরিবহনের কৌশল আপনার মূল্যবান জিনিসপত্রকে সুরক্ষিত রাখে। মুভিংয়ের জন্য সমস্ত কার্যক্রম তারা পরিচালনা করে, যা আপনার কাজের চাপ কমায়।
শেষ কথা
বাসা পরিবর্তনের মতো বড় এবং জটিল কাজটিও সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে এটি অনেক সহজ এবং মসৃণ হতে পারে। আশা করি, বাসা পরিবর্তনের কার্যকর উপায়গুলো আপনি এখানে খুঁজে পেয়েছেন! এই সব বিষয়গুলি মাথায় রেখে আপনার বাসা পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি আরও সুশৃঙ্খল এবং মসৃণ হবে।
সম্পর্কিত প্রশ্নাবলী ও উত্তর
প্রশ্ন ১: বাসা পরিবর্তনের মুভিং ডে তে কি করতে হবে?
উত্তর:বাসা পরিবর্তন দিন আপনার পূর্বের করা লিস্টটি বার বার চেক করা সব কাজ ঠিকমতো হয়েছে কিনা। মালামালের সমস্ত প্যাক গাড়িতে উঠেছে কিনা।
লেভেলিং দেখে ডাবল চেক করা।
প্রশ্ন ২: বাসা পরিবর্তনের পর কি কি সার্ভিসের প্রয়োজন হতে পারে?
উত্তর: নতুন বাসায় শিফট হওয়ার পর এসি, গিজার, প্লাম্বিং, ওয়াইফাই লাইন সেট আপ ইত্যাদি সার্ভিসিং এর প্রয়োজন হতে পারে। তাই বাসা পরিবর্তনের পূর্বেই এগুলো সার্ভিসিং করিয়ে নিতে হবে।
প্রশ্ন ৩:মুভিং সার্ভিস কি সব ধরনের কাজ করে?
উত্তর: সব মুভিং সার্ভিস প্রদানকারী কোম্পানি সব ধরনের কাজ করে না। কিছু কোম্পানি শুধু প্যাকিং এবং ট্রান্সপোর্টেশন করে, অন্যরা ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং, অথবা ফার্নিচার মাউন্টিং সার্ভিসও প্রদান করে। আগে থেকেই নিশ্চিত করুন তারা কোন সার্ভিস দেয়।