বাংলাদেশে পুরাতন ট্রাক বেচা-কেনার আদ্যোপান্ত
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পরিবহণ শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পরিবহণ শিল্পে অন্যতম প্রয়োজনীয় মাধ্যম ট্রাক। পণ্য পরিবহণ, কাঁচামাল, কৃষিপণ্য, ডেলিভারি ব্যবসা, বাসা শিফট ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্রাকের ব্যবহার বেশি হয়। তবে, নতুন ট্রাকের দাম অনেক বেশি। তাছাড়া, বাংলাদেশে নতুন ট্রাক সম্পূর্ণ তৈরি অবস্থায় আসে না। ফলে অনেক সময় নতুন ব্যবসায়ী, ছোট এবং মাঝারি ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত কাজে নতুন ট্রাক কেনা অনেকের জন্যই কষ্টকর হয়ে ওঠে । তাই পুরাতন ট্রাক কেনা অনেকের জন্য সবচেয়ে ভালো অপশন হয়ে উঠেছে। সে সাথে, পুরাতন ট্রাক বিক্রির বাজার সরব হয়ে উঠছে সময়ের সাথে। আজকের ব্লগে, বাংলাদেশের পুরাতন ট্রাক বেচা-কেনার প্রক্রিয়া, কোথায় বেচাকেনা করবেন, এর সুবিধা-অসুবিধা এবং গুরুত্বপূর্ণ টিপস নিয়ে আলোচনা করবো।
সুবিধা
- পুরাতন ট্রাক কেনার প্রধান সুবিধা হলো নতুন ট্রাক কেনার খরচ বাঁচে, কেননা এর কম দাম। তাছাড়া নতুন ট্রাকের তুলনায় পুরাতন ট্রাকের ইনস্যুরেন্স খরচ সাধারণত কম হয়। ফলে আপনার আরও কিছু সাশ্রয় ঘটবে।
- নতুন যেকোনো কিছু কিনে ব্যবহারের সাথে সাথেই এর মূল্য কমে যায়। তাই পুরানো ট্রাক কিনলে, নতুন গাড়ির প্রথম কয়েক বছরে হওয়া দ্রুত মূল্য হ্রাস এড়ানো যায়।
- পুরানো ট্রাকের বাজার যেমন বিশাল, তেমনি অপশনও বেশি। তাই নিজের সুবিধা অনুযায়ী ট্রাক খুঁজে পাবেন।
অসুবিধা
- পুরাতন ট্রাক কেনার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এর বর্তমান অবস্থা সঠিকভাবে যাচাই করা। যেহেতু ট্রাক ভারি কাজের জন্য ব্যবহার হয়, তাই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এর ক্ষতি হতে পারে।
- অনেক সময় পুরানো ট্রাকের আগের সম্পূর্ণ ইতিহাস জানা কঠিন হয়ে যায়। আগের মালিকেরা কীভাবে ব্যবহার করেছে, কোনো দুর্ঘটনায় পড়েছিল কি না, সেগুলো সবসময় জানা যায় না। তাই, বিশ্বস্ত কারো কাছ থেকে লেনদেন করা উচিত।
- বিদেশ থেকে আমদানি করা ট্রাকের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে পাওয়া নাও যেতে পারে। তাই ট্রাক কেনার আগে, এর সব ধরনের যন্ত্রাংশ সহজলভ্য কি না তা নিশ্চিত করতে হবে।
- পুরানো ট্রাক কেনার সময় চেক করতে হবে যে তা বাংলাদেশের পরিবহণ নীতি ও ট্রাফিক আইন মেনে চলছে কি না।
পুরাতন ট্রাক কেনার টিপস
বাজেট: যেকোনো কিছু কেনার প্রথম ধাপ হলো, বাজেট নির্ধারণ করা। ট্রাক কেনার বাজেটের সাথে অবশ্যই কেনার পর রেজিস্ট্রেশন, ইনস্যুরেন্স, এবং মেরামতের জন্য অতিরিক্ত খরচও যোগ করতে হবে।
গাড়ির অবস্থা পরীক্ষা: কেনার আগে ট্রাকটি সরাসরি পরীক্ষা করে দেখুন। বিশেষ করে, ইঞ্জিন, ব্রেক, টায়ার এবং সাসপেনশনের অবস্থা ভালো করে চেক করুন। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি একজন দক্ষ মেকানিক দিয়ে ট্রাকটি সম্পূর্ণ পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া যায়।
কাগজপত্র যাচাই: ট্রাকের রেজিস্ট্রেশন, কর, ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি আপডেট আছে কি না চেক করে নিবেন। তাছাড়াও, বিক্রেতা আসল মালিক কি না, ট্রাকের কোনো ঋণ বা জরিমানা আছে কি না তা যাচাই করতে হবে। সম্ভব হলে, মালিকের পরিচয় নিশ্চিত করতে এনআইডি চেক করে নিতে হবে। প্রয়োজনীয় কাগজ প্রমাণ স্বরূপ সাথে রাখবেন।
টেস্ট ড্রাইভ: যেকোনো গাড়ি কেনার আগে টেস্ট ড্রাইভ অবশ্যই করে নেওয়া উচিত। ট্রাক কেনার ক্ষেত্রেও এটি ব্যতিক্রম নয়। ট্রাকটি কীভাবে চলছে, চলার সময় কোনো অস্বাভাবিক শব্দ আছে কি না, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না এবং যাত্রাপথ কতটা আরামদায়ক তা চেক করে নিন।
বিশ্বস্ত ডিলার: সরাসরি কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে কেনার চেয়ে, বিশ্বস্ত ডিলারের কাছ থেকে কেনা বেশি ভালো। কিছুটা বাড়তি নিরাপত্তা পাওয়া যায়। অনেক ডিলার ব্যবহৃত ট্রাকের ওয়ারেন্টি দেয়। ফলে পরবর্তী যেকোনো সমস্যা হলেও, আপনি স্বস্তিতে ডিলারের কাছে যেতে পারবেন।
পুরাতন ট্রাক বেচা-কেনার স্থান
বাংলাদেশে পুরাতন ট্রাক বেচা-কেনার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে, যেমন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, পুরানো ট্রাক কেনাবেচার বাজার এবং ডিলারশিপ।
১. অনলাইন মার্কেটপ্লেস
বর্তমানে যেকোনো কিছু বেচাকেনার অন্যতম স্থান হয়ে উঠেছে অনলাইন। অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে পণ্য বেচাকেনা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য সহজ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিক্রয়.কম (Bikroy.com): বিক্রয়.কম বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ওয়েবসাইট। এটি নিরাপদ এবং এর যথেষ্ট পরিচিতি আছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের ট্রাকের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সাথে থাকে ট্রাকের বিস্তারিত বিবরণ ও ছবি। ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই সহজে বিজ্ঞাপন দিতে পারে এবং বিজ্ঞাপন থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ফিল্টার করে ট্রাক কিনতে পারে।
ফেসবুক মার্কেটপ্লেস: ফেসবুক মার্কেটপ্লেস বর্তমানে পণ্য বেচাকেনার অন্যতম প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এখানেও পুরানো ট্রাকের বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়। ক্রেতা-বিক্রেতারা সরাসরি যোগাযোগ করে দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করতে পারবে এখানে।
২. পুরানো ট্রাক কেনাবেচার বাজার
অনেকেই ট্রাকের মতো বৃহৎ এবং ব্যবসার অন্যতম উপাদান অনলাইনে লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তবে চিন্তার কিছু নেই। তাদের জন্য রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের পুরাতন ট্রাকের বাজার। এই বাজারগুলোতে বিভিন্ন ডিলার ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সরাসরি ট্রাক বেচাকেনা হয়ে থাকে।
ধোলাইখাল, ঢাকা: এটি ঢাকা শহরের সবচেয়ে পুরানো ও বড় গাড়ি এবং এর যন্ত্রাংশের বাজার। এখানে পুরানো ট্রাকের পাশাপাশি খুচরা যন্ত্রাংশ এবং সার্ভিস পাওয়া যায়।
তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা: তেজগাঁওতে অনেক পুরাতন ট্রাক ডিলার ও শো-রুম রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ট্রাক পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম ট্রাক মার্কেট: বাংলাদেশের প্রাথমিক বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। পণ্য আমদানি ও রপ্তানির একটি প্রধান কেন্দ্র হিসাবে সেখানকার ট্রাক বাজার খুবই প্রাণবন্ত ও সক্রিয়। ক্রেতারা পুরানো ট্রাকের অনেক অপশন পাবেন, যার মধ্যে অনেকগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে।
বরিশাল ট্রাক মার্কেট: বরিশাল ট্রাক মার্কেট আকারে ছোট হলেও, এর প্রসার বাড়ছে সময়ের সাথে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যারা আছেন তাদের জন্য এটি একটি সুবিধাজনক স্থান। এখানে স্থানীয় বিক্রেতা এবং ক্রেতারা তাদের পছন্দের পুরানো ট্রাক খুঁজে পেতে পাবেন।
৩. ডিলারশিপ
একটি পরিচিত ডিলারশিপ থেকে পুরাতন ট্রাক কেনাবেচা বাড়তি নিরাপত্তা প্রদান করে, যেটি অন্যান্য মাধ্যম প্রদান করতে পারে না। ডিলারশিপগুলো বেশিরভাগই নিয়মিত তাদের যানবাহনের যত্ন নেয় এবং সাথে ওয়ারেন্টিও দিতে পারে। যদিও ডিলারশিপে দাম অন্যান্য স্থানের তুলনায় সামান্য বেশি হতে পারে। তবে এটি আপনাকে নিশ্চয়তা ও স্বস্তি প্রদান করবে।
নাভানা লিমিটেড: বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ অটোমোবাইল কোম্পানি, নাভানা লিমিটেড প্রায়ই নতুন এবং পুরাতন উভয় ট্রাক নিয়ে কাজ করে। তাদের নির্ভরযোগ্যতার জন্য বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। তাছাড়া তাদের পুরানো ট্রাকগুলো সাধারণত বিক্রয়ের জন্য তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ব্যাপক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়।
নিটল মোটরস: নিটোল মোটরস ভালো অবস্থায় পুরাতন ট্রাক কেনার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য জায়গা। সারা দেশে তাদের শো-রুম রয়েছে, ফলে ক্রেতারা সহজেই তাদের যেকোনো একটি শাখাতে পছন্দের ট্রাক খুঁজে পাবে।
রানার অটোমোবাইলস: যদিও রানার, মোটরসাইকেল এবং ছোট যানবাহনের জন্য পরিচিত, তবে তারা বাণিজ্যিক ট্রাকেরও ব্যবসা করে। তাদের ব্যবহৃত যানবাহন বিভাগে প্রায়ই ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা পুরানো ট্রাক থাকে।
৪. নিলাম
বাংলাদেশে পুরাতন ট্রাক কেনা-বেচার আরেকটি উপায় হলো নিলামের মাধ্যম। এই ইভেন্টগুলো ট্রাকসহ বিভিন্ন ব্যবহৃত যানবাহনের জন্য হয়ে থাকে, যেখানে ক্রেতারা বিড করতে পারে। নিলামগুলো দর কষাকষির জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। তবে, এক্ষেত্রে ট্রাক ভালোভাবে চেক করে নিতে হবে।
সরকারি নিলাম: অনেক সময়, সরকার ব্যবহৃত যানবাহন নিলাম করে, যার মধ্যে ট্রাকও রয়েছে৷ এই নিলামগুলো সাধারণত সংবাদপত্র এবং অনলাইনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেওয়া হয়।
ব্যক্তিগত নিলাম: কিছু ব্যক্তিগত কোম্পানি গাড়ির নিলামও করে, যেখানে বিভিন্ন কোম্পানি বা ব্যক্তি তাদের পুরাতন ট্রাক তালিকাভুক্ত করতে পারে। ক্রেতারা ব্যক্তিগতভাবে এই নিলামে অংশ নিতে পারেন বা অনলাইনেও অংশগ্রহণ করতে পারেন।
৫. পরিচিত মানুষের মাধ্যমে
পরিচিত মানুষের মাধ্যমেও পুরাতন ট্রাক কেনা-বেচা চলে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। অনেক ক্রেতা এবং বিক্রেতা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বা ব্যক্তিগত রেফারেলের মাধ্যমে বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সাথে ডিল করতে পছন্দ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি স্থানীয় পরিবহণ কোম্পানি তাদের ব্যবহৃত ট্রাকগুলোকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগে তাদের নেটওয়ার্কের মধ্যে অন্য ব্যবসা বা ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করতে পারে। অভ্যন্তরীণ বা স্থানীয় পরিবহণ সংস্থার সাথে নেটওয়ার্কিং আপনাকে এমন সুযোগ খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশে পুরাতন ট্রাক বেচাকেনা করা একটি সহজ কাজ হতে পারে যদি আপনি জানেন কোথায় এবং কীভাবে এই কাজ করতে হবে। আপনি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সুবিধা, ডিলারশিপের নিশ্চয়তা বা স্থানীয় বাজার যেটিই পছন্দ করুন না কেন, সেখানে আপনার জন্য অনেক বিকল্প রয়েছে৷ শুধু রিসার্চ করার সময় মনে রাখবেন, গাড়িটি নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং সাথে কোনো আইনি বা যান্ত্রিক সমস্যা এড়াতে সমস্ত কাগজপত্র নিশ্চিত করবেন। অনলাইন এবং অফলাইন দুই উপায়েই খুঁজে দেখুন। আশা করি, আমাদের ব্লগ আপনার কাজ আরও সহজ করবে এবং আপনি আপনার পছন্দের বড় কিংবা মিনি ট্রাক খুঁজে পাবেন।