কুরিয়ারে ফ্রিজ পাঠানোর নিয়ম ও খরচ
দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই আমাদের বিভিন্ন জিনিস এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠাতে হয়; কখনো দেশের বাইরে, কখনো বা দেশের বাইরে থেকে নিজ দেশে। এসব ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিসই আমাদের একমাত্র ভরসার জায়গা। সময়ের সাথে কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর অনেক উন্নতি হয়েছে। ডকুমেন্ট থেকে শুরু করে ফ্রিজের মতো বড় আসবাবপত্রও পাঠানো হচ্ছে কুরিয়ারে। তবে অবশ্যই আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস নিরাপদে যাতে পৌঁছে সেজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
ফ্রিজের মতো ভারি এবং বড় পণ্য কুরিয়ারে পাঠানো কিছুটা কঠিন হলেও, নিয়ম মেনে প্যাকেজিং করলে এই কাজ সহজ হয়ে যাবে। অনেকে খরচ নিয়ে চিন্তায় থাকেন। আজকের ব্লগে, আমরা ফ্রিজ কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানোর নিয়ম এবং খরচ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
খরচ নির্ধারণের দিক
কুরিয়ারে যেকোনো পণ্য পাঠানোর জন্য খরচ নির্ধারিত থাকে। এটি নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপর। ফ্রিজ পাঠানোর ক্ষেত্রেও কুরিয়ারের খরচ নির্ধারণের জন্য কিছু বিষয় রয়েছে।
আকার এবং ওজন: কুরিয়ার কোম্পানিগুলো প্রথমেই পণ্যের আকার ও ওজনের উপর নির্ভর করে কুরিয়ার ফি নির্ধারণ করে থাকে। ফ্রিজের ওজন বেশি হলে এবং আকার বড় হলে, খরচও বেশি হবে।
দূরত্ব: ডেলিভারির স্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্থানীয় ডেলিভারিতে খরচ কম, যেমন ঢাকার কোনো কোম্পানি থেকে পণ্য ঢাকার মধ্যে যেকোনো স্থানে খরচ কম। কিন্তু ঢাকার বাইরে খরচ বেশি। আবার আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের জন্য খরচ আরও বেড়ে যায়।
প্যাকেজিং খরচ: ফ্রিজের মতো দামি আর বড় পণ্যের ক্ষেত্রে কুরিয়ার ফি ছাড়াও কিছু খরচ যুক্ত হয়। অনেক সময়ই কুরিয়ার কোম্পানিগুলো প্যাকেজিংয়ের অতিরিক্ত চার্জ যুক্ত করে। যেহেতু ফ্রিজের মতো পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন প্যাকেজিং যেমন ফোম, কার্টন, বক্স বা প্লাস্টিক কাভার প্রয়োজন হতে পারে, সে হিসাবে খরচ বাড়তেও পারে।
ইন্স্যুরেন্স: অনেক সময় কিছু কুরিয়ার কোম্পানি দামি ও ভঙ্গুর পণ্য ডেলিভারির জন্য ইন্স্যুরেন্স করার উপদেশ দেয়। যা ফ্রিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। ইন্স্যুরেন্সের খরচ ফ্রিজের দামের উপর নির্ভর করে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের তুলনা
ফ্রিজের মতো পণ্য অনেক সময়ই কুরিয়ারে দেশের বাইরে পাঠানো হয়। আবার দেশের বাইরে থেকে আনাও হয়। আবার ঢাকার মধ্যে এবং বাইরে আনা-নেওয়াও হয়। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের খরচের পার্থক্য জেনে নেওয়া ভালো।
স্থানীয় কুরিয়ার সার্ভিস
স্থানীয় কুরিয়ার সার্ভিসের খরচ সাধারণত বেশি হয় না। এটি দূরত্ব আর ওজনের উপরই বেশি নির্ভর করে। সাথে ডেলিভারি চার্জ আর ভ্যাট যুক্ত হতে পারে। কুরিয়ারে ঢাকার ভেতরে বা কাছাকাছি জেলায় ফ্রিজ পাঠানোর জন্য ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস
স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসে খরচ অনেক বেশি হয়। এখানে দেশ, কাস্টম ফি, অন্যান্য কিছু খরচও যুক্ত হয়। এই খরচ $১০০ থেকে $৫০০ বা আরও বেশিও হতে পারে।
আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর খরচ
ফেডএক্স (FedEx)
ফেডএক্স একটি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস। ফ্রিজের মতো বড় আকারের পণ্য পরিবহণের জন্য এটি উপযুক্ত। একটি ফ্রিজ ফেডএক্সের মাধ্যমে পাঠানোর জন্য প্রায় $২০০ থেকে $৪০০ লাগতে পারে।
ডিএইচএল (DHL)
বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি কুরিয়ার সার্ভিস হলো ডিএইচএল। এটি মূল্যবান ও ভারি পণ্য পরিবহণের জন্য নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। ডিএইচএল আন্তর্জাতিক সার্ভিসের ক্ষেত্রে ডেলিভারির স্থান অর্থাৎ দেশ ও পণ্যের ওজনের উপর ভিত্তি করে খরচ নির্ধারণ করে। যেমন, একটি ৫০ কেজি ওজনের ফ্রিজ পাঠানোর জন্য $১৫০ থেকে $৩০০ এর মধ্যে খরচ হতে পারে।
বাংলাদেশি কুরিয়ার সার্ভিস
বাংলাদেশের বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি ফ্রিজের মতো বড় পণ্য দক্ষতার সাথে পরিবহণ করে থাকে। ফ্রিজের ওজন ও গন্তব্যের উপর নির্ভর করে খরচ ভিন্ন হয়ে থাকে। তাছাড়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে খরচ আরও বাড়তে পারে।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (Sundarban Courier Service)
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও নির্ভরযোগ্য কুরিয়ার কোম্পানি। তারা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রীর সাথে ফ্রিজও পরিবহণ করে থাকে। তাদের কাজের মান এখন পর্যন্ত জনপ্রিয়। ঢাকার মধ্যে এবং অন্যান্য বড় শহরে ফ্রিজ কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠাতে পার সি.এফ.টি. (CFT) ১৫০ টাকা করে খরচ হবে।
করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস (কেসিএস)
করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসেস (KCS) বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত কুরিয়ার কোম্পানি, যা তার দক্ষ সার্ভিস এবং নির্ভরযোগ্যতার জন্য পরিচিত। এর উন্নত পরিবহণ সুবিধা এবং অভিজ্ঞ কর্মীরা ক্লায়েন্টদের আস্থা অর্জন করেছে। করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস সারা দেশ জুড়ে তাদের সেবা দিয়ে থাকে। করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ফ্রিজ পাঠাতে চাইলে, আপনার খরচ পড়বে পার সি.এফ.টি. (CFT) ২০০ টাকা।
লালামুভ (Lalamove)
লালামুভ মূলত লজিস্টিক সার্ভিস এবং হোম শিফটের কাজ করলেও, ফ্রিজের মতো বড় পণ্যের জন্য তাদের রয়েছে বিভিন্ন ক্যাপাসিটির ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। বর্তমানে তারা ঢাকা, টঙ্গী, আশুলিয়া, গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও রূপগঞ্জে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। ফ্রিজের জন্য তাদের ১ টনের ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যানই যথেষ্ট। এছাড়া তাদের ১ টনের পিকআপ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ৫ ঘণ্টার জন্য ভাড়া নেওয়ারও ব্যবস্থা আছে।
লালামুভের মাধ্যমে ফ্রিজ পাঠাতে হলে আপনার খরচ হবে ৬৪০-২৭৫০ টাকা পর্যন্ত। স্থানভেদে এই খরচ পড়তে পারে ৮০০-১৪০০ টাকা পর্যন্ত। দ্রুত ডেলিভারির জন্য ব্যবহার করতে পারেন লালামুভের প্রায়োরিটি ফি, এতে খরচ একটু বাড়বে। স্থানভেদে তা ১০০০-১৬০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ঢাকার ভিতরে ডেলিভারি ফি আর প্রায়োরিটি ফি দুটির খরচই কমতে পারে।
এই খরচ ট্রাফিক পরিস্থিতি, অর্ডারের পরিমাণ, প্রযোজ্য টোল, সারচার্জ ইত্যাদির কারণের উপর নির্ভর করে। তাই খরচ পরিবর্তিত হতে পারে। তার সাথে ড্রাইভার এবং অতিরিক্ত হেল্পার চাইলে খরচ হবে যথাক্রমে ৩০০ টাকা হেল্পার প্রতি ৭০০ টাকা। এছাড়া ক্যাশ অন ডেলিভারি এবং মাল্টিপল স্টপের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১০০ টাকা করে যোগ হতে পারে।
বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের খরচের তুলনা
কুরিয়ার সার্ভিসের নাম |
খরচের বিবরণ |
ফেডএক্স (FedEx) |
$২০০ থেকে $৪০০ |
ডিএইচএল (DHL) |
$১৫০ থেকে $৩০০ |
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (Sundarban Courier Service) |
পার সি.এফ.টি. (CFT) ১৫০ টাকা |
করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিস (কেসিএস) |
পার সি.এফ.টি. (CFT) ২০০ টাকা |
লালামুভ (Lalamove) |
৬৪০-২৭৫০ টাকা, সাথে অতিরিক্ত খরচ যোগ হতে পারে। স্থানভেদে খরচ ৮০০-১৪০০ টাকা পর্যন্ত। প্রায়োরিটি ফি স্থানভেদে ১০০০-১৬০০ টাকা পর্যন্ত। |
কুরিয়ারে ফ্রিজ পাঠানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ টিপস
ফ্রিজের মতো বড় পণ্য কুরিয়ারে পাঠানোর সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখবেন।
সঠিকভাবে প্যাকেজিং করা: যেকোনো পণ্য নিরাপদে ডেলিভারির জন্য সবার আগে দরকার সঠিক নিয়মে প্যাক করা। তাহলে আপনার পণ্য যেমন ঠিক থাকবে, তেমনি ডেলিভারি হবে নিশ্চিন্তে। ফ্রিজের ক্ষেত্রে শক্ত কার্টন বা বক্স, ফোম এবং বাবল র্যাপ ব্যবহার করতে হবে।
ইন্স্যুরেন্স গ্রহণ: ফ্রিজের মতো মূল্যবান পণ্যের ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্স করা উচিত। তাহলে কুরিয়ারের সময় যেকোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও, ইন্স্যুরেন্স কাজে আসবে।
মালবাহী কুরিয়ার কোম্পানি নির্বাচন: চেষ্টা করবেন বিশেষ রকমের মালবাহী কুরিয়ার সার্ভিস বেছে নিতে। এ ধরনের সার্ভিসগুলো ভারি পণ্য যেমন ফ্রিজ পরিবহণের জন্য দক্ষ ও নিরাপদ।
কুরিয়ার কোম্পানির রিভিউ যাচাই: অবশ্যই যেকোনো সার্ভিস নেওয়ার জন্য কোম্পানির রিভিউ দেখে নেওয়া উচিত। লজিস্টিক এবং কুরিয়ার কোম্পানি অনেক থাকলেও, ফ্রিজ যত্ন ও নিরাপত্তার সাথে যারা পাঠাতে পারবে এমন কোম্পানি বেছে নিন। তাই রিসার্চের সময় রিভিউ ও কাস্টমার ফিডব্যাক দেখে নিন।
সঠিক সময় বেছে নেওয়া: ছুটির সময় বা ইমার্জেন্সি ডেলিভারির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ফি দিতে হয়। খরচ বাঁচাতে চাইলে, কম ব্যস্ত সময় বেছে নিতে পারেন যেমন সপ্তাহের অন্যান্য দিন। এবং সম্ভব হলে ইমার্জেন্সি ডেলিভারি এড়িয়ে চলুন।
কুরিয়ারে ফ্রিজ পাঠানো অনেকের জন্য চিন্তার বিষয় হতে পারে। কিন্তু এখন অনেক অপশন এবং কুরিয়ার সার্ভিসগুলোও অনেক উন্নত। মনে রাখবেন, কুরিয়ারে ফ্রিজ পাঠানোর খরচ নির্ভর করে দূরত্ব, ওজন এবং কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ের উপর। সঠিকভাবে প্যাকিং করে পছন্দের সার্ভিসে নিশ্চিন্তে কুরিয়ার করতে পারবেন। আশা করি, আজকের ব্লগ আপনাকে প্রতিটি ধাপে সাহায্য করবে।