ল্যাপটপ কেনার আগে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে

featured image

ল্যাপটপ এখন আর বিলাসিতা না। সময়ের সাথে এটি হয়ে উঠেছে এক অপরিহার্য অংশ। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্রে, ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিনোদন এবং ব্যক্তিগত কাজে ল্যাপটপ এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স পণ্যের মতো এটিও কেনার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করা দরকার। এতে করে একদিকে যেমন আপনার অর্থ অপচয় হবে না। তেমনি, সখের আর প্রয়োজনীয় জিনিস না কিনতে পারার কষ্টও হবে না।

আজকের ব্লগে ল্যাপটপ কেনার আগে খেয়াল রাখতে হবে এমন কিছু বিষয় আলোচনা করবো।

১. প্রয়োজন নির্ধারণ 

ল্যাপটপ কেনার সময় সবার আগে যে দিকটি খেয়াল রাখতে হবে তা হলো আপনার প্রয়োজন নির্ধারণ করা। একেকটি ল্যাপটপ একেক কাজের জন্য ভাল। যদি আপনি তা না বুঝে কিনেন, তাহলে দেখা যাবে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী আপনি আউটপুট পাচ্ছেন না। 

পড়াশোনা: বর্তমানে প্রায় সব ধরনের পড়াশোনার জন্যই ল্যাপটপ দরকার হয়। সেক্ষেত্রে একটি বেসিক ল্যাপটপ যা সাশ্রয়ী এবং সাথে আছে লং ব্যাটারি লাইফ, তা হতে পারে আপনার জন্য আদর্শ। 
কর্মক্ষেত্র: যদি আপনি আপনার কাজের জন্য তা হোক অফিস বা ফ্রিল্যান্স কাজ, ল্যাপটপ কিনতে চান তাহলে আপনার প্রয়োজন হাই পাওয়ারের প্রসেসরযুক্ত ল্যাপটপ। সে সাথে থাকতে হবে পর্যাপ্ত স্টোরেজ এবং মাল্টিটাস্ক করার ক্ষমতা।
গেম এবং গ্রাফিক্স ডিজাইন: গেম খেলা, ভিডিয়ো এডিটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি কাজের জন্য কিনতে হবে হাই রেজুলেশন স্ক্রিন, ফাস্ট প্রসেসর এবং উন্নত গ্রাফিক্স কার্ড যুক্ত ল্যাপটপ । 

২. বাজেট 

বাজেট পরিকল্পনা যেকোনো কিছু কেনার জন্য সবার আগে করতে হয়। বাজারে অনেক ধরনের এবং দামের ল্যাপটপ পাওয়া যায়। প্রতিনিয়ত এসব পণ্যের আপডেট হচ্ছে। তাই, এতো জিনিসের মাঝে চিন্তিত না হয়ে, আপনি কত টাকা খরচ করতে পারবেন তা ঠিক করতে হবে। তবে অবশ্যই একদম কম দামের না খুঁজে আপনার প্রয়োজনের সাথে মিল রেখে কেনার চেষ্টা করুন।

৩. প্রসেসর এবং র‍্যাম

ল্যাপটপ কেনার সময় অবশ্যই প্রসেসর এবং র‍্যাম সম্পর্কে জানতে হবে। কারণ আপনার কাজ দ্রুত হওয়ার জন্য এবং ল্যাপটপের ভালো পারফর্মেন্সের জন্য এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রসেসর: প্রসেসরের ব্র্যান্ডের মধ্যে ইন্টেল এবং এএমডি (AMD) বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয়। সাধারণ কাজের জন্য ইন্টেলের Core i3, i5, i7, i9—i3, মাল্টিটাস্কিং এবং গেমিং এর জন্য i5 এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কাজের জন্য i7 বা i9 উপযুক্ত। এএমডির Ryzen সিরিজের প্রসেসরগুলোর মধ্য থেকে Ryzen 3, Ryzen 5, Ryzen 7, Ryzen 9 ইত্যাদি থেকে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রসেসর বেছে নিতে পারেন।
র‍্যাম: বেসিক কাজের জন্য ৮ জিবি র‍্যাম এবং ২৫৬ জিবি এসএসডি এর মতো কনফিগারেশন উপযুক্ত। তবে বেশি ভারী কাজ যেমন ডিজাইন, ইলাস্ট্রেশন বা গেমিং এর ক্ষেত্রে ১৬ জিবি বা তার বেশি র‍্যামযুক্ত ল্যাপটপ কেনার চেষ্টা করুন। 

৪. স্টোরেজ টাইপ এবং ক্যাপাসিটি

ল্যাপটপের স্টোরেজ এবং ক্যাপাসিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনার কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন সফটওয়্যার, ফাইল ডাউনলোডের দরকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে ল্যাপটপে যদি পর্যাপ্ত স্টোরেজ না থাকে বা মাল্টিটাস্ক করার ক্যাপাসিটি না থাকে; তাহলে আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটবে এবং ল্যাপটপও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

দ্রুত গতির ক্ষেত্রে এসএসডি স্টোরেজ থাকা ল্যাপটপ কিনতে পারেন। ভালো স্পিডের জন্য ৭২০০ আরপিএমের হার্ডডিস্ক নিতে পারেন। আর সাধারণ কাজের জন্য ৫২০০ আরপিএমের হার্ডডিস্ক চলবে। তবে আপনার বাজেট কম হলে এইচডিডি স্টোরেজও আপনাকে বেশি স্টোরেজের সুবিধা দিবে। কিন্তু এটি তুলনামূলক ধীর গতির। এটি বড় ফাইল স্টোর করার জন্য বেশি কার্যকর।

কিছু ল্যাপটপে এসএসডি আর এইচডিডি দুটোই থাকে, যা স্পিড এবং স্টোরেজের জন্য ভালো।

৫. ব্যাটারি লাইফ

ল্যাপটপের ব্যাটারি লাইফ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে, আপনি যদি বাইরে কাজ করেন অথবা গেমিং বা ভিডিয়ো এডিটিং এর মতো ভারী কাজ করেন; তাহলে আপনার দরকার লং ব্যাটারি লাইফ। কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা ব্যাটারি ব্যাকআপ আছে এমন ল্যাপটপ কিনুন। ব্যাটারি ব্যাকআপ ব্র্যান্ড ও মডেলের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হয়। 

হুট করে জরুরি কাজের সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে, আপনার কাজ শেষ করতে দরকার ভালো ব্যাটারি ব্যাকআপ। ব্যাটারির লাইফ, ক্যাপাসিটি এবং ব্যাকআপ  চেক করে ল্যাপটপ কিনবেন। ৪৪Wh থেকে ৫০Wh এর মধ্যে থাকা ব্যাটারি সম্বলিত ল্যাপটপ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। 

৬. ডিসপ্লে এবং রেজুলেশন 

আপনার কাজের অভিজ্ঞতার সাথে ল্যাপটপের স্ক্রিন  এবং রেজুলেশনের সম্পর্ক রয়েছে। তাই ডিসপ্লে এবং রেজুলেশন দেখে নিন। ডিসপ্লে সাইজের মধ্যে ১৩-১৫.৬ ইঞ্চি আকারের স্ক্রিন বেশি জনপ্রিয়। তবে আপনার কাজভেদে ডিসপ্লে সাইজ এবং রেজুলেশন ভিন্ন হবে। ফুল এইচডি (1920x1080) রেজোলিউশন ভালো। বাজেট বেশি হলে 4K ডিসপ্লে কিনতে পারেন।

ল্যাপটপের ডিসপ্লের টাইপ: 
Twisted Nematic (TN)
In-Plane Switching (IPS)
Organic Light-emitting Diode (OLED)

৭. গ্রাফিক্স কার্ড

গ্রাফিক্স কার্ড ল্যাপটপের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার, বিশেষ করে গেমিং বা ভিডিয়ো এডিটিং এর মতো কাজের জন্য। এসব কাজ না করলে আপনার গ্রাফিক্স কার্ড না হলেও চলবে।

ইন্টিগ্রেটেড গ্রাফিক্স: সাধারণ কাজ
ডেডিকেটেড গ্রাফিক্স: হাই-এন্ড গেমিং বা গ্রাফিক্স কাজ করা যাবে। যেমন এনভিডিয়া (NVIDIA) বা এএমডি’র ডেডিকেটেড গ্রাফিক্স কার্ড জিটিএক্স ১০৫০ থেকে ১০৮০ বা আরও আধুনিক। তাছাড়া আসুসের গেমিং ল্যাপটপ আরওজি স্ট্রিক্স স্কার এডিশন এবং বাজেট বেশি হলে আসুস আরওজি জেফ্রাস গেমিং বা হাই-কনফিগারেশনের সেরা ল্যাপটপ হতে পারে।

৮. পোর্ট এবং কানেক্টিভিটি

আপনার ল্যাপটপে পর্যাপ্ত পোর্ট এবং কানেক্টিভিটি অপশন থাকা প্রয়োজন।
ইউএসবি ৩.০ এবং টাইপ-সি পোর্ট আছে না কি চেক করুন। এটি তাড়াতাড়ি ডেটা ট্রান্সফার করতে পারে। ফলে আপনার সময় বাঁচবে।
এইচডিএমআই, ইথারনেট, এবং হেডফোন জ্যাক আছে কি না দেখতে হবে।
ওয়াই-ফাই এবং ব্লুটুথ সুবিধা অবশ্যই থাকতে হবে। ওয়াই ফাই অ্যাডাপ্টরের ক্ষমতা দেখতে হবে বিশেষ করে ডুয়াল ব্যান্ডের অ্যাডাপ্টর ভালো। ব্লুটুথের ক্ষেত্রে ব্লুটুথ ৪.o ভালো।

৯. অপারেটিং সিস্টেম

ল্যাপটপের অপারেটিং সিস্টেম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনার কাজের প্রয়োজন অনুযায়ী অপারেটিং সিস্টেম পছন্দ করুন।
উইন্ডোজ: সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত।
ম্যাকওএস: ক্রিয়েটিভ প্রফেশনালদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত।
লিনাক্স: ডেভেলপারদের জন্য ভালো অপশন। 

১০. কিবোর্ড এবং টাচপ্যাড

দ্রুত আর আরামদায়ক টাইপিং এবং স্মুথ টাচপ্যাড পাওয়ার জন্য কিবোর্ড ও টাচপ্যাড চেক করে নিবেন। ব্যাকলিট কিবোর্ড অন্ধকারে টাইপের বাড়তি সুবিধা দেয়।  

১১. ওজন এবং বহনযোগ্যতা

আপনি ল্যাপটপ কীভাবে ব্যবহার করবেন সেটার উপর নির্ভর করে আপনি কত ওজনের ল্যাপটপ কিনবেন। নিয়মিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহজে বহনযোগ্য এমন হালকা ওজন বেছে নিন। চাইলে নোটবুক কিনতে পারেন।

ল্যাপটপের ওজন এর স্ক্রিনের সাইজের উপর নির্ভরশীল। ১১ থেকে ১২ ইঞ্চি ল্যাপটপের ওজন ১.১-১.৫ কেজি। ১৩ থেকে ১৪ ইঞ্চি ল্যাপটপের ওজন ১.৮ কেজির নিচে । বাড়িতে ব্যবহার করতে চাইলে ১৫ ইঞ্চি ডিসপ্লে বিশিষ্ট ২.৫ কেজি থেকে ৩ কেজি ওজনের ল্যাপটপ ভালো হবে।

১২. ব্র্যান্ড এবং ওয়ারেন্টি

যেকোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্য কেনার আগে ব্র্যান্ড চেক করে নিবেন। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রিভিউ এবং রেটিং দেখে একটি নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড বেছে নিন। অ্যাপল, ডেল, আসুস, লেনোভো, এইচপি ইত্যাদি ভালো ব্র্যান্ড হিসাবে পরিচিত। অন্তত ১ বছরের ওয়ারেন্টি এবং সে সাথে সার্ভিসিং এর সুবিধা দেখে ল্যাপটপ কেনা উচিত।

১৩. অতিরিক্ত টিপস 

ক্যামেরা: অফিসের কাজে বিশেষ করে যারা ফ্রিল্যান্সিং বা রিমোট জব করেন তাদের ভিডিয়ো কলের জন্য, একটি ভালো মানের হাই রেজুলেশনের ক্যামেরা থাকা দরকার ।
সাউন্ড কোয়ালিটি: ব্যক্তিগত ব্যবহার, বিনোদন বা কাজের জন্য ভালো সাউন্ড সিস্টেম প্রয়োজন। 
আপগ্রেড করার সুবিধা: র‍্যাম বা স্টোরেজ আপগ্রেড করার সুবিধা আছে না কি, চেক করে দেখুন।
টাচস্ক্রিন চাইলে উইন্ডোজ ৮ ইন্টারফেসের টাইল ও জেশ্চার ভালো হবে। উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের ল্যাপটপে ওয়েব পেজ ব্যবহার করা, ছবি ও ডকুমেন্টস দেখা সহজ। আপনি সাথে কিবোর্ড যুক্ত করতে পারেন। 

ল্যাপটপ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় বিনিয়োগ। তাই সময় নিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ড, ল্যাপটপের বিভিন্ন ফিচার চেক করে সিদ্ধান্ত নিন। বাজারের এতো ল্যাপটপ দেখে চিন্তা করবেন না। আজকে আলোচ্য বিষয়গুলো খেয়াল রাখলেই আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। আশা করি, আজকের ব্লগ আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। এবং আপনাদের পছন্দের ল্যাপটপ বাজেটের মধ্যে বেছে নিতে পারবেন।

 

আরও পড়ুন এসি কেনার আগে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে

Read more