এসি কেনার আগে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে
দিন দিন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। শীতপ্রধান দেশগুলোও এখন প্রচণ্ড দাবদাহের স্বীকার হচ্ছে। গত ২-৩ বছরে বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। সে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসি কেনার পরিমাণ। কিন্তু এসি কেনার সাথে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত আছে। যেমন, কোন এসি তার রুমের জন্য ভালো, কোন এসিতে বিদ্যুৎ বিল কম হবে, এসি কত টনের কিনবেন, এসির প্রকার, এর ব্যবহার ইত্যাদি সকল বিষয় নিয়ে একটি বিস্তারিত দিক নির্দেশনা দেওয়া হবে আজকের এই আর্টিকেলে।
রুমের আকার
সবার আগে দেখতে হবে, আপনি যে রুমের জন্য এসি নিচ্ছেন তার আকার। এসি বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ হচ্ছে এসির বাড়তি লোড। অর্থাৎ যেখানে ৩ টনের এসি প্রয়োজন সেখানে যদি ১ টনের এসি থাকে, তাহলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঘরের আয়তনের সাথে এর অবস্থান, সূর্যের আলো কতোটা পড়ছে, কয়জন থাকবে ইত্যাদির উপরও নির্ভর করে।
- ১০০-১২০ বর্গফুটের রুম- ১ টনের এসি
- ১২০-১৫০ বর্গফুটের রুম- দেড় টন এসি।
- এর চেয়ে বেশি আয়তনের জন্য- ২ টনের এসি
প্রয়োজনের বেশি টনের এসিতে রুম বেশি ঠান্ডা হয়ে, বিদ্যুৎ বিল বেড়ে যাবে। আবার কম টনের হলে, কম্প্রেসরে চাপ পড়ে এসি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই ইলেকট্রিশিয়ানের মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে, আপনার বাড়িতে সে পরিমাণ বিদ্যুৎ টানার সক্ষমতা আছে কিনা।
ইনভার্টার
ইনভার্টার ছাড়া এসি কিনবেন, না ইনভার্টারসহ সেটা ঠিক করতে হবে। ইনভার্টার থাকলে ঘর ঠান্ডা হওয়ার পর এসির কম্প্রেসর অটো বন্ধ হয়ে যায়। কম্প্রেসর কম ক্যাপাসিটিতেও চলতে পারে, তাই বিদ্যুৎ খরচ কম হয়।
নন ইনভার্টারগুলোর ক্ষেত্রে রুম ঠান্ডা হওয়ার পর কম্প্রেসর বন্ধ হয়ে যায়। আবার রুমের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে, পুনরায় চালু হয়। বারবার মোটরটি অন-অফ করাতে বিল বেশি হয়।
স্প্লিট এসি বনাম উইন্ডো এসি
স্প্লিট এসির কম্প্রেসর ঘরের বাইরে রাখা যায়, কিন্তু এতে দেয়াল ভাঙতে হবে। অপরদিকে, উইন্ডো এসির জন্য একটি জানালা বন্ধ করে দিতে হবে। আর ঘরে অন্য কোনো জানালা না থাকলে, আলো বাতাস ঢোকার জায়গা বন্ধ হয়ে ঘরে গুমোট আবহ তৈরি হতে পারে। এর ইভাপোরেটর কয়েল (evaporator coil) রুমের ভেতরে থেকে রুম ঠান্ডা করে। আর বাইরে থাকা অংশ বা কন্ডেন্সার কয়েল (condenser coil) রুমের ভেতরের গরম বাতাস বাইরে পাঠায়।
স্প্লিট এসিতে সব ফিচার আছে। উইন্ডো এসি, স্প্লিট এসির থেকে তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায়। তাই, আপনার সুবিধা বুঝে বেছে নিন। এই এসিতে ওয়াটার বা এয়ার-কুলড কন্ডেন্সিং ইউনিট আলাদা থাকে। সাধারণত, বসার ঘর, অফিসের বড় রুমে স্প্লিট এসি বেশি ব্যবহৃত হয়।
পোর্টেবল এসি : এর ফ্লেক্সিবল এগজস্ট পাইপ জানালা বা দেয়ালে ছিদ্র করে বাইরের দিকে রাখতে হয়। এটি সহজে বহন করা যায় এবং দামও কম।
সেন্ট্রাল এসি: বড় শপিং সেন্টার, হাসপাতাল, অফিস ইত্যাদি কমার্শিয়াল স্থানে এ ধরনের এসি ব্যবহৃত হয়।
হাইব্রিড এসি: সোলার প্যানেলের সাহায্যে এটি চলে। এটি পরিবেশবান্ধব তবে সহজলভ্য নয়।
উপাদান
ব্লোয়ার ফ্যান এসির বাতাস ছড়িয়ে দেয়। ব্লোয়ার ফ্যান যত বড়, তত বেশি বাতাস পাওয়া যাবে। কনডেনসার কয়েল ঠান্ডা করার গতি বাড়ায়। কনডেনসার কয়েলের তাপ বিনিময় ক্ষমতা ভালো থাকতে হবে, সাথে থাকতে হবে ক্ষয়রোধী বৈশিষ্ট্য। ক্যাপাসিটর সার্কিট ফেইল কিংবা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করে।
এসির ফিল্টার বাতাস থেকে ময়লা, জীবাণু, ধোঁয়া এবং গন্ধ দূর করে। উঁচু মানের ফিল্টার ধুলাবালি যেন কয়েলে না পৌঁছায় সেটাও নিশ্চিত করে এসির কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
এসির এয়ারফ্লো কত এবং ফ্ল্যাপস আছে কি না তা ভালোভাবে দেখে তারপর এসি কিনুন। ফ্ল্যাপ ম্যানুয়ালি ও রিমোট কন্ট্রোল দুইভাবেই অ্যাডজাস্ট করা যায়। আপনার সুবিধামতো বেছে নিন।
অ্যালুমিনিয়াম এসির দাম কপার এসির থেকে একটু বেশি। কপার তাড়াতাড়ি হিট তৈরি করতে পারে, তাই এর কার্যক্ষমতা বেশি। ফলে বিদ্যুৎ বিলও কম হয়।
গ্যাসের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব গ্যাস ব্যবহারের চেষ্টা করবেন। যেমন, ৪১০এ গ্যাস সবচেয়ে নিরাপদ কারণ এটি ওজোন স্তরের ক্ষতি করে না।
ব্র্যান্ড
যেকোনো কিছু কেনার আগে ভালো ব্র্যান্ড দেখে কেনা জরুরি। কেননা, এতে লম্বা সময়ের জন্য বিনিয়োগ করতে পারবেন। এসির মতো জিনিসে ভালো ব্র্যান্ড আরও জরুরি। বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিয়ে রিসার্চ করুন, তাদের রিভিউ দেখুন, আপনার বাজেটের সাথে তুলনা করুন, পরিচিতদের অভিজ্ঞতা জানুন। সাথে তাদের সার্ভিস অফার, আপনার কাছাকাছি সার্ভিস সেন্টার এবং ওয়ারেন্ট চেক করে নিবেন। অনলাইনে কিনলে ডেলিভারি আর ইন্সটলেশন চার্জ দেখে নিবেন।
গ্রি
বাংলাদেশের অন্যতম পরিচিত একটি ব্র্যান্ড । গ্রি ১ টন থেকে ৫ টন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাপাসিটির স্প্লিট, উইন্ডো এবং পোর্টেবল এসি বিক্রি করে। এদের কম্প্রেসারের লাইফ টাইম বেশি থাকায় এক কম্প্রেসার অনেকদিন ব্যবহার করা যায়।
মিডিয়া
মিডিয়া এয়ার কন্ডিশনারের এসিতে শব্দ কম হয়। রয়েছে ওয়াই-ফাই সংযোগ, এয়ার পিউরিফায়ার, ডিহিউমিডিফায়ার ইত্যাদি ফিচার। এখানে স্প্লিট, উইন্ডো, পোর্টেবল এবং ক্যাসেট ইউনিটের পাশাপাশি ভেরিয়েবল রেফ্রিজারেন্ট ফ্লো সিস্টেমসহ বিভিন্ন এসি রয়েছে।
জেনারেল
আবাসিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এই ব্র্যান্ড পরিচিত। তাদের জেনারেল এসিতে হিউম্যান সেন্সর, হট এবং কুল ফাংশন, ভি-পিএএম ইনভার্টার, হাই-ডেনসিটি মাল্টি-পাথ, হিট এক্সচেঞ্জার, নেগেটিভ এয়ার আয়নস ডিওডোরাইজিং ফিল্টার ইত্যাদি প্রযুক্তি রয়েছে।
প্যানাসনিক
প্যানাসনিক জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড। তাদের এয়ার পিউরিফায়ার এবং ডিহিউমিডিফায়ার ফিচার এলার্জি বা শ্বাসকষ্টের সমস্য রয়েছে এমন ব্যক্তির জন্য উপকারী। তাছাড়া এই ন্যানো এক্স টেকনোলোজি জীবাণু ধবংস করে।
ওয়ালটন
বাংলাদেশের নিজস্ব ব্র্যান্ড ওয়ালটন। তাদের উন্নত প্রযুক্তি এবং বাজেটবান্ধব হওয়াতে দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
স্যামসাং
অতিরিক্ত গরমের জন্য এই ব্র্যান্ডের পরিচিতি আছে। তাদের এসিতে ডিজিটাল ইনভার্টার টেকনোলোজি, এয়ার পিউরিফিকেশন, ডিহিউমিডিফিকেশন সিস্টেম এবং স্মার্ট এয়ার ফ্লো সিস্টেম রয়েছে।
এলজি
এলজি অনেক জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড। তাদের ডুয়াল ইনভার্টার টেকনোলোজি, স্মার্ট কন্ট্রোল, এয়ার পিউরিফায়ার এবং ডিহিউমিডিফায়ারের মতো মাল্টি এয়ার ফ্লো সিস্টেম রয়েছে। এছাড়া অটো ক্লিনিং, স্মার্ট থিংক টেকনোলোজি এবং স্মার্ট ডায়াগনোসিস টেকনোলোজি রয়েছে।
এছাড়া আছে হিটাচি, মিতসুবিসো, শাওমি, শার্প, ভিশন ইত্যাদি ব্র্যান্ড।
রেটিং
ব্র্যান্ড দেখার সাথে সাথে, ‘ব্যুরো অব এনার্জি এফিসিয়েন্সির স্টার রেটিং’ দেখতে হবে। এসির গায়ে স্টিকারে এই রেটিং দেওয়া থাকে। স্টারের সংখ্যা যত বেশি, কার্যক্ষমতা তত বেশি। সাথে বিদ্যুৎ বিলও কম আসবে। যেমন একটি স্টার থাকলে, সেই এসি বছরে ৮৪৩ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং ঘণ্টায় আড়াই থেকে সাড়ে তিন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বাঁঁচায়। আবার পাঁচ স্টার থাকা মানে এটি বছরে ৫৫৪ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং সাড়ে তিন থেকে পাঁচ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে।
দাম
ব্র্যান্ড এবং টনের উপর এসির দাম নির্ভর করে। আবার বেশি স্টারযুক্ত এসির দাম অনেক বেশি। বর্তমান সময়ে, তাপদাহের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে এসির চাহিদাও বাড়ছে। ফলে, এর দামও বাড়ছে।
ওয়ালটন: ইনভার্টার ১ টন ৬২ হাজার ৯০০, দেড় টন ৭২ হাজার, নন ইনভার্টার ১ টন ৪৬ হাজার ৯০০ টাকা।
ট্রান্সটেক: ইনভার্টার ১ টন এসির দাম ৫৯ হাজার ৭০৮ টাকা। দেড় টন ৭৯ হাজার ৯৪৮ টাকা এবং দুই টনের দাম ৯৩ হাজার ২৮৮ টাকা।
মিনিস্টার : ১.৫ টন ইনভার্টার ৭২ হাজার ৯০০, ২ টন ইনভার্টার ৮০ হাজার ৯০০ টাকা।
যমুনা : ১ টন ৪৫ হাজার ৭২০ টাকা, ২ টন ৭৮ হাজার ১২০ টাকা, দেড় টন ৬৫ হাজার ৫২০ টাকা
ভিশন: ১ টন ৩৯ হাজার ৫১০ টাকা, দেড় টন ৫৯ হাজার ৩১০ টাকা, ২ টন ৭৩ হাজার ৭১০ টাকা
মিডিয়া: ১ টন ৪৩ হাজার টাকা, দেড় টন ৫৯ হাজার টাকা, ২ টন ৬৮ হাজার টাকা
স্যামসাং: ইনভার্টার ১ টন এসির দাম ৭৩ হাজার ৯০০ টাকা, দেড় টন ৯৫ হাজার ৯০০ টাকা এবং দুই টনের দাম ১ লাখ ৭৯০০ হাজার টাকা।
ওয়ার্লপুল: ইনভার্টার ১ টনের এসির দাম ৭৫ হাজার ৬৩০ টাকা। দেড় টন ৯৪ হাজার ৭৪৩ টাকা।
হিটাচি: দেড় টনের ইনভার্টার এসির দাম ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০ টাকা। দুই টনের দাম ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৫০ টাকা।
জেনারেল: ইনভার্টার ১ টন এসির দাম ৮১ হাজার ৪০০ টাকা। দেড় টন ১ লাখ ১৫ হাজার ৯০০ টাকা
এসির দাম সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। অনুগ্রহ করে পুনরায় বর্তমান প্রাইস চেক করে নিবেন।
এসির যত্ন
- লম্বা সময় এসি না চালিয়ে, মাঝে মাঝে বিরতি দিতে হবে।
- এসির বাইরের অংশে খোলামেলা ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখবেন।
- বছরে দুবার ফিল্টার পরিষ্কারের সাথে কম্প্রেসর চেক করতে হবে।
- বেশি ব্যবহৃত হলে ৬ মাসে একবার এবং কম ব্যবহৃত হলে বছরে একবার এসি সার্ভিসিং করাতে হবে।
- তাপমাত্রা ২৫ বা তার বেশি দিয়ে রাখলে বিদ্যুৎ বিল কম আসে।
- বার বার এসি অন-অফ না করে টাইমার, টার্বো কুলিং মুড বা স্লিপিং মুড ব্যবহার করতে পারেন।
এসি বর্তমানে একটি প্রয়োজনীয়তায় পরিণত হয়েছে। তবে এর সাথে যেহেতু অর্থ এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে, তাই সময় নিয়ে ভালোভাবে রিসার্চ করে কেনা উচিত। আশা করি, আমাদের আর্টিকেল আপনাকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পেরেছে।
এসি পরিবহনে পিকআপ ভাড়া করতে এখনই ইন্সটল করুন লালামুভ মোবাইল অ্যাপ।