রিয়েল এস্টেট ব্যবসার বর্তমান ট্রেন্ড

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বর্তমানে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি বিনিয়োগের অন্যতম খাতে পরিণত হয়েছে। তবে, সময়ের সাথে সব ব্যবসায়ই পরিবর্তন দেখা যায়। গত কয়েক বছরে এই খাতেও অনেক ধরনের বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির প্রসার, অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ, কোভিড-১৯ মহামারি, মানুষের চাহিদা আর সময়ের দ্রুত পরিবর্তনের ফলে রিয়েল এস্টেট খাত নিত্য নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে।
এখন এটি শুধু জমি বা ফ্ল্যাট বেচাকেনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সে সাথে প্রযুক্তি নির্ভর পরিকল্পনা, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো, ক্রেতার চাহিদা এবং চিন্তাধারার উপর নির্ভর করছে। আজকের ব্লগে, বর্তমানে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় কী কী ট্রেন্ড প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
১. ডিজিটাল প্রভাব
আগে রিয়েল এস্টেটের জন্য প্রথমেই নিজে গিয়ে জমি দেখতে হতো, ভবন বা ফ্ল্যাট ঘুরে দেখা থেকে কাগজপত্র ঘেঁটে যাচাই-বাছাই করতে হতো। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এর পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ এজেন্ট, ডেভলপার, ক্রেতা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন ফেসবুক পেজ, ইউটিউব ভিডিও, ওয়েবসাইট এবং ভার্চুয়াল ট্যুর ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। এর মাধ্যমে ঘরে বসে ফ্ল্যাট কিংবা প্লট দেখা যাচ্ছে সহজে এবং কম সময়ে। এমনকি অনেকে ভিডিও কলে যোগাযোগ করে ফ্ল্যাট পর্যন্ত বুক করে ফেলছেন।
এছাড়া, ডিজিটাল পেমেন্ট এবং অনলাইন কাস্টমার সার্ভিস এই খাতকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ ও সাশ্রয়ী করেছে। ২০২৫ সালে, এআই (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত বিশ্লেষণের ট্রেন্ড রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগে প্রাধান্য পাবে। ফলে কাজের গতি বাড়বে, ঝুঁকি হ্রাস করবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। তবে এটি প্রতিযোগিতাও বাড়াতে পারে, সম্পত্তির দাম বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
২. স্মার্ট হোম ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা
বর্তমানে অনেক ক্রেতাই তাদের বাসায় আধুনিক প্রযুক্তির সংযুক্তি চান। যেমন, সিসিটিভি ক্যামেরা, স্মার্ট লক, মোশন সেন্সর, রিমোট কন্ট্রোল লাইট বা ফ্যান ইত্যাদি। স্মার্ট হোম ফিচার সমৃদ্ধ অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ি এখন জনপ্রিয় ট্রেন্ড। দাম বেশি হলেও মধ্য ও উচ্চবিত্ত ক্রেতারা এগুলোর প্রতি আগ্রহী। আইওটি ডিভাইস এবং হোম অটোমেশন সিস্টেমের মতো স্মার্ট হোম প্রযুক্তি শহরের ক্রেতাদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রিমোট জব এবং হোম অফিসের জন্য অনেকে বড় বাসা বা ভিন্ন ডিজাইন বেছে নিচ্ছেন। সে সাথে জনপ্রিয় হচ্ছে শেয়ারড ওয়ার্কস্পেস।
৩. পরিবেশবান্ধব স্থাপনা
সময়ের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সব ব্যবসার উপরই পড়েছে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসাও এর ব্যতিক্রম নয়। ফলে এই খাতে জড়িত সবাই চেষ্টা করছে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই স্থাপনা করতে। এই পুরো প্রক্রিয়াও যাতে ইকো-ফ্রেন্ডলি হয় সে চেষ্টাও থাকছে। যেমন অনেক ডেভেলপার ‘গ্রিন বিল্ডিং’ ট্রেন্ডের দিকে ঝুঁকছেন।
সে সাথে সোলার প্যানেল, প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবহার, বৃষ্টির পানির ব্যবহার এবং রিসাইকেল উপযুক্ত উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণের চাহিদা বাড়ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ ও পানির খরচ কমায়, যা ক্রেতাদের কাছে একটি বাড়তি সুবিধা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
৪. ছোট পরিবার উপযোগী ফ্ল্যাট
গত কয়েক বছরে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে গিয়েছে। সময়ের সাথে বাংলাদেশে ছোট পরিবার, ব্যাচেলর বা একা বসবাসের জন্য ছোট আকারের ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়ছে। সে সাথে খরচের জন্যও অধিকাংশ পরিবার ছোট আয়তনের বাসা বেশি পছন্দ করে। এসব ফ্ল্যাটের দাম তুলনামূলক কম, রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম এবং ব্যস্ত শহরে দ্রুত কেনাবেচা সম্ভব। ফলে ডেভেলপাররাও এরকম প্রকল্পের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
৫. শহরের আশেপাশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি
গত কয়েক বছরে পড়াশোনা, চাকরি, বিভিন্ন দরকারে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে মানুষের ভিড় বাড়ছে। সে সাথে বাড়ছে যানজট ও জমির দাম। ফলে অনেকেই শহরের মূল অংশ রেখে আশেপাশের স্থানের দিকে ঝুঁকছেন। যেমন ঢাকার ক্ষেত্রে পূর্বাচল, সাভার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় নতুন নতুন হাউজিং প্রজেক্ট গড়ে উঠছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এই স্থানগুলোকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য, এই জায়গাগুলো চমৎকার বিকল্প।
৫. ঋণ ও ফাইন্যান্স স্কিম
বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের সুবিধার জন্য অনেক রকমের হোম লোন ও সহজ শর্তে কিস্তির সুবিধা দিচ্ছে। এতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও নিজেদের জন্য স্থায়ী কিছু করার স্বপ্ন দেখতে সাহস পাচ্ছেন। পাশাপাশি ডেভেলপাররাও নিজেদের বিভিন্ন ফাইন্যান্স স্কিম চালু করেছে, যেখানে আগাম কিছু টাকা দিয়ে কিস্তিতে ফ্ল্যাট কেনা যায়। এই সুবিধাগুলো রিয়েল এস্টেট খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
৬. নারীদের অংশগ্রহণ
আগে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় নারীদের ভূমিকা তুলনামূলক কম ছিল। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন নারীরা শুধু ক্রেতা হিসাবেই নয়, সে সাথে এজেন্ট, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী হিসাবেও কাজ করছেন। অনেক নারী উদ্যোক্তার নিজস্ব হাউজিং কোম্পানি রয়েছে। এটি নারী ক্ষমতায়নের পাশাপাশি রিয়েল এস্টেট খাতেও বৈচিত্র্য আনছে।
৭. উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে সরে যাওয়া
২০২৫ সালে, বীমা ঝুঁকি এবং ভাড়া বাতিলের কারণে বিনিয়োগকারীদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে, বিশেষ করে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। এটি অন্য বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। ফলে এই অঞ্চলগুলোতে প্রথমবারের মতো বাড়ি কিনবে এমন ক্রেতারা আরও বেশি সুযোগ পেতে পারে।
বর্তমান সময়ে সব কিছুর খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। ট্রেন্ড যেমন দ্রুত আসছে, তা আবার দ্রুত চলেও যাচ্ছে। রিয়েল এস্টেট এখন আর শুধু প্রপার্টি কেনাবেচা নয়। পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে রিয়েল এস্টেট খাতও এগিয়ে চলছে নতুন এক সম্ভাবনার পথে। এর সাথে আছে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির প্রভাব, সমাজ এবং জীবনযাত্রার সাথে পরিবর্তিত ট্রেন্ড। তাই প্রতিযোগিতায় টিকে সফল হতে, দরকার সময় ও ট্রেন্ড বুঝে কাজ করা। সে সাথে ক্রেতাদের সচেতনভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলেই, উভয় পক্ষ লাভবান হতে পারবে।
আরও পড়ুন উদ্যোক্তাদের বিজনেস রেজিস্ট্রেশনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র